অমিত প্রামানিক সোডিয়াম বাতির গান। এতটুকু বললেই মোটামুটি সবাই এখন চেনে ব্যাপারটা কি। আমি যখন প্রথম ক্যাম্পাসে আসি, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে, তখনো সোডিয়াম বাতির গান কেউ চেনে না। আমাদের বিতর্ক অঙ্গনের এক পরিচিত বড় ভাই, ইয়াসিন শাফি, আমাকে একদিন বললেন, ‘সোডিয়াম বাতির গান নামে একটা অনুষ্ঠান করব টিএসসি গেমস রুমে, থাইকো।’ তখন জীবনে অজস্র সময় এবং উত্তেজনা। ক্যাম্পাসের কোন অনুষ্ঠান মিস করার মানেই হয়না। সেইবার খুব ছোট্ট করে গেমস রুমে সোডিয়াম বাতির গানের প্রথম মৌসুমের প্রথম পর্ব হয়। খুব অল্প মানুষ। সবাই মোটামুটি ক্যাম্পাসেরই পরিচিত মানুষ। নিজেরা নিজেরাই টাকা উঠিয়ে সাউন্ড আর ব্যানার নিয়ে শো শুরু। অ্যাকুইস্টিক একটা গানের শো। হালকা আওয়াজ। টিকেট-ফিকেটের ঝামেলা নেই! আসবেন, হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসবেন, কোন মঞ্চ নেই, একই সমতলে শ্রোতা ও আর্টিস্ট গলা মিলিয়ে গাইবেন! ভালো না লাগলে যেকোন সময় চলেও যেতে পারবেন। আমার খুব ভালো লাগলো পুরো আয়োজনটা। তারপর কীভাবে কীভাবে যেন এর আয়োজনের পেছনে জড়িয়ে গেলাম আস্তে আস্তে। এরপর অনেক সময় কেটে গেছে। এবছর আমরা পঞ্চম মৌসুম শুরু করছি। এরইমধ্যে সোডিয়াম বাতির গান পৌঁছে গেছে শহরের হাজারো মানুষের কাছে। গেমস রুমে আমরা কোনভাবেই এখন আর শো করতে পারি না। এত মানুষ হয়ে যায় যে গরমে নিঃশ্বাস ফেলা যায় না গেমস রুমে! আমরা এখন টিএসসি সুইমিং পুলে নিয়মিত শো করি। সেই সুইমিংপুলও কানায় কানায় ভরে ওঠে। সোডিয়াম বাতির গান শোনার জন্য শহরের নানান প্রান্তের মানুষ একটা নির্দিষ্ট দিনে বিকেল-সন্ধ্যার মধ্যে জীবনের সব কাজ গুছিয়ে টিএসসি চলে আসে গান শুনতে। ভক্তরা লোগোওয়ালা টিশার্ট পরে চিৎকার করে গানের সাথে গলা মেলায়। অনেক ব্যান্ড গান গাইতে চায় প্রতি পর্বে। আমরা সবাইকে সুযোগও দিতে পারি না। এই যে, প্রথম পর্বের ছোট্ট সোডিয়াম আস্তে আস্তে হাজার মানুষের গানের অনুষ্ঠানে পরিণত হলো, তবুও সোডিয়াম বাতির গানের আয়োজনের গল্পটা কিন্তু সেই প্রথম এপিসোডের মতোই রয়ে গেছে। এখনো আমরা চেনা জানা বড় ভাই-আপু, অনেক শ্রোতা ভক্তদের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে সাউন্ডের ব্যবস্থা করি, ১০ ফুট বাই ৪ ফুট একটা ব্যানার বানাই আর যারা গান গায় তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করি। এতটুকুই! টাকার খুব যে দরকার হয়েছে বা আমরা সংকটে পরেছি কখনো এমনও কিন্তু না। কারণ, শুরু থেকেই আমরা চেয়েছি ক্যাম্পাসের এবং শহরের বিভিন্ন উঠতি ব্যান্ড বা মিউজিশিয়ানরা যে গান গায় সেই গানগুলোকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আমি জানি, অনেক শ্রোতাই প্রতি পর্বের ইভেন্ট ফেসবুকে আসার পর অপেক্ষা করেন জানার জন্য এবার কোন বড় ব্যান্ড আসছে। কিন্তু এই আয়োজনের পেছনে আমরা যারা আছি, আমাদের মনোযোগটা নতুন বা স্বল্প পরিচিত কোন ব্যান্ড বা আর্টিস্টকে শ্রোতাদের সামনে নিয়ে আসার দিকেই সবসময় বেশি থাকে। তাই, অনেক বড় করে সোডিয়াম বাতির গান আয়োজন করতে হবে বা অনেক বিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে আসতে হবে --- এই ধরনের চাপ আমরা যারা সোডিয়াম বাতির গানের আয়োজক, আমরা কখনোই নেইনি। সোডিয়াম বাতির গান আমরা যতবারই আয়োজন করেছি, আমরা কখনো কারো থেকে টিকেট বাবদ কোন টাকা নেইনি। আমরা সবসময় চেয়েছি, এটা যেন একটা ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’ শো থাকে। আবার আমরা কোন আর্টিস্টকে কখনো কিছু দিতেও পারিনি। আর্টিস্টরা শ্রোতাদের টানে, সোডিয়ামকে ভালোবেসে গান করেছেন। আমরা কখনো স্পন্সর নেইনি, নেওয়ার চেষ্টাও করিনি। আমরা চেয়েছি, পুরো আয়োজনটাকে সর্বোচ্চ যতটুকু অর্গানিক রাখা যায়, সেভাবে রাখতে। আমরা যে পেরেছি, এখনো প্রতিনিয়ত পারছি সেজন্যে দর্শকদের অসংখ্য ধন্যবাদ। দিন দিন শ্রোতা বেড়েছে, এবং এত এত শ্রোতা হয়েছে বলেই আর্টিস্টরা বিনে পয়সাও গেয়েও আনন্দ পেয়েছেন, নতুন আর্টিস্টদের আমরা দিন দিন আরো বড় প্ল্যাটফর্ম দিতে পেরেছি। আমাদেরও আয়োজনটা চালিয়ে যেতে কোন স্পন্সরের কাছেও আর যেতে হয় নি কখনো। এই চক্রটা বোঝা খুব জরুরি। এটাই সোডিয়াম বাতির গান। এখানে আর্টিস্টরা অংশগ্রহণ করেন গান গেয়ে, আমরা অংশগ্রহণ করি আয়োজক হিসেবে, আর আপনারা যারা শ্রোতা তারা অংশগ্রহণ করেন গান শুনতে শুনতে। এভাবে প্রত্যেকটা মানুষের অংশগ্রহন আমাদের আয়োজনটাকে আস্তে আস্তে এই পঞ্চম মৌসুমে নিয়ে এসেছে। সোডিয়াম বাতির গানের প্রতি পর্বেই খুব ব্যস্ততার মাঝেও হঠাৎ মাঝে মাঝে আমি আটকে যাই। অবাক হয়ে দেখি শত শত মানুষ সুন্দর হয়ে বসে মন দিয়ে গান শুনছে, দুলে দুলে গান গাইছে। তখন মনে হয়, এই যে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান সোডিয়াম বাতির গান, তার বদৌলতে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন ক্যাম্পাসের মানুষের এই দুঃখ-দুর্দশা-হতাশার শহরকে ভুলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এক হওয়া, একসাথে বসা, একই গান শুনা, একই তালে গলা মেলানো, এই আয়োজন চলতে থাকুক, এই গান চলতে থাকুক। কখনো শেষ না হোক।
তাই যেন হয়।
1 Comment
মোঃ আরিফুল হাসান সোহাগ
2/1/2020 10:59:57 pm
লেখাটি পড়তে পেরে অনেক ভাল লাগল। ক্যাম্পাসের জনপ্রিয় এই আয়োজনটির উদ্ভব কিভাবে হয়েছিল, কারা এই অনুষ্ঠানটির পেছনে নিবেদিত প্রাণ সেটি জানার আগ্রহ সবসময়ই বোধ করতাম। ধন্যবাদ লেখক ও এই প্লাটফর্ম কে।
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |