নাহিয়ান বিন খালেদ এদেশে অর্থনীতি চর্চার ইতিহাস কম দীর্ঘ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাধ্যমে এদেশে স্থানীয়ভাবে অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা চর্চার সূচনা হয়। এর আগে এদেশের যেসকল শিক্ষার্থী অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা নিতে চাইতেন, তাঁরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর বাঙালিদের মধ্যে অর্থনীতি চর্চা একটা বাড়তি গতি লাভ করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বয়স কিন্তু একেবারে কম নয়। প্রায় ৯৭ বছর! এর পাশাপাশি বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ রয়েছে। এইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ব্যাচেলর অব সোশ্যাল সায়েন্স (বিএসএস)/ ব্যাচেলর অব সায়েন্স (বিএসসি) এবং মাস্টার অব সোশ্যাল সায়েন্স (এমএসএস)/ মাস্টার অব সায়েন্স (এমএসসি) ডিগ্রী নেওয়া যায়। তবে এদেশে অর্থনীতি চর্চার বহুদিন হলেও অর্থনীতিতে পড়ার পরের ক্যারিয়ার নিয়ে ধাঁধায় থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারে কম নয়। এই সিরিজটিতে অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্যারিয়ার হিসেবে গবেষণা পেশা নিয়ে আলোচনা করা যাক। সিরিজে একে একে আলোচনা করব গবেষণায় কাজ করার বিভিন্ন দেশীয় প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, সেখানে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা এবং দক্ষতা নিয়ে। ![]() অর্থনীতিতে গবেষণা ক্ষেত্রের ভূমিকা- রিসার্চ বা গবেষণা অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের চর্চিত একটি পেশা। অর্থনীতির জনক এ্যাডাম স্মিথ থেকে শুরু করে আজকের জোসেফ স্টিগলিটজ তাঁদের জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন গবেষণা পেশায় নিয়োজিত হয়ে। বাংলাদেশেও অনেক বড় বড় অর্থনীতিবিদ গবেষণা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং এখনও আছেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান বা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতন বড় বড় গবেষকের জন্ম এদেশেই। ১৯৭১ সালের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তৎকালীন তরুণ অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের রচিত গবেষণাপত্রে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছিল, যা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলো! অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য। এভাবে দেশের নীতিনির্ধারণের জন্য গবেষণার ফলাফল কাজে এসেছে, এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে। তেমনি ভাবে, বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদদের প্রচুর সংখ্যক একাডেমিক গবেষণা শীর্ষস্থানীয় জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ।তবে শুরুতেই তাঁদের মতন না হতে পারার কারণে যে নিজেকে গবেষক বলা যাবে না, ব্যাপারটা কিন্তু একদমই সত্যি না। গবেষণা আর দশটা পেশার মতনই একটি পেশা। এই পেশাতেও এন্ট্রি লেভেলের চাকরি আছে, যেখানে গবেষণা সহযোগী/গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আছে। পর্যায়ক্রমে পদোন্নতির সুযোগ থাকে এই পেশাতেও। নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদন্ড, মেধা এবং কর্মদক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন উচ্চপদে কাজ করার সুযোগ আছে এই পেশায়। অনেকে ফুলটাইমার শিক্ষক হিসেবে কাজ করে পার্টটাইমার হিসেবেও গবেষণা করে থাকেন। সেই ক্ষেত্রে তারা কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকতে পারেন অথবা নিজ উদ্যোগে গবেষণা পরিচালনা করেন। বাংলাদেশে অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনেকে মনে করেন, “বাংলাদেশে আবার গবেষণা হয় নাকি?” এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে দিতেই পারেন। তবে ইতিবাচক ব্যাপার হল, অর্থনীতি সংক্রান্ত গবেষণার জন্য বাংলাদেশেই অনেক ভালো মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দেখা গেছে, শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম, কাজের ধরণ এবং কাজের সুযোগ সম্পর্কে না জানার কারণে অনেক সম্ভাবনাময় গবেষক গবেষণা পেশা থেকে দূরে চলে যান। তাই এই পর্ব একে একে কয়েকটি বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নাম বলছি- ১) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বি আই ডি এস) বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন গবেষণার জন্য সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান হল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বি আই ডি এস)। স্বাধীনতার আগে থেকেই পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স নামে এই প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স এবং ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ নামে কার্য পরিচালনা শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের সময় থেকেই বেশ কয়েকজন বাঙালি মেধাবি অর্থনীতিবিদ কাজ করেছেন এই প্রতিষ্ঠানে। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক অর্থনীতিবিদই কাজ করেছেন/করছেন এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফেলো, গবেষণা পরিচালক ও মহাপরিচালকের পদে। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য গবেষণার বাইরেও একাডেমিক গবেষণাতেও নিয়োজিত আছে এই প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করার পর গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ থাকে এখানে। সেজন্য কিছু পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ এর মুখোমুখি হতে হয়। পদ খালি থাকা সাপেক্ষে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে। ২) ব্র্যাক (আর ই ডি, বিআইজিডি, জেপিজিএস) বর্তমানে বিশ্বের ১ নম্বর এনজিও হিসেবে সদর্পে বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্র্যাক। সেই কারণে ব্র্যাকের নাম অনেকেরই চেনা। বাংলাদেশের ব্র্যাকের বহু কার্যক্রমের মধ্যে একটি হচ্ছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি) পরিচালনা করা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। BRAC Institute of Governance and Development অথবা বি আই জি ডি হল তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, সুশাসন, রাজনৈতিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক এবং উন্নয়ন নিয়ে গবেষণায় আগ্রহ থাকলে বি আই জি ডি হতে পারে খুব ভালো জায়গা। ব্র্যাকের রিসার্চ এ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিপার্টমেন্ট-ও বেশ দুর্দান্ত কিছু গবেষণার কাজ করেছে অতীতে। বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান, দাতা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে বেশ কিছু বিশ্বখ্যাত জার্নালে তাদের গবেষকদের গবেষণা প্রকাশিতও হয়েছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হল, জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাব্লিক হেলথ। বিভিন্ন বিষয়ের গবেষক প্রয়োজন হয় এখানে। বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের মানুষ গবেষণার কাজ করে এখানে। অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ে যাদের আগ্রহ, তারা খোঁজ রাখতে পারে এই প্রতিষ্ঠানে। তিনটি প্রতিষ্ঠানই সময়ে সময়ে ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের গবেষণা সহযোগী বা গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন পদে হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে।এর জন্য স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওয়েবসাইটে খোঁজ রাখতে হবে। ![]() ৩) সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বাজেট ঘোষণার সময় বাজেট পর্যালোচনার জন্য এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের জন্য সিপিডি’র নাম অনেকেই পত্রপত্রিকায় দেখে থাকি।২৫ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা করা এই প্রতিষ্ঠানটিতে বেশ কয়েকজন সিনিয়র গবেষক কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মতন ম্যাক্রো-ইকোনমিক গবেষণার পাশাপাশি হাউজহোল্ড-ভিত্তিক মাইক্রো পর্যায়ের গবেষণাও করে প্রতিষ্ঠানটি। সিপিডি মোটামুটি নিয়মিতই তরুণ গবেষক নিয়োগ করে থাকে। সাধারণত প্রথমে প্রোগ্রাম এসোসিয়েট পদে নিয়োগ করে একটি নির্ধারিত প্রবেশনের সময় পার হওয়ার পর গবেষণা সহযোগী বা রিসার্চ এসোসিয়েট পদে পদোন্নতি দেয় তারা। ৪) সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিরও গবেষণায় সুনাম রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক গবেষণার পাশাপাশি অভ্যন্তরীন অর্থনীতি বিষয়েও গবেষণা করে থাকে সানেম। তারা গবেষণার পাশাপাশি গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালাও আয়োজন করে থাকে। ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের সাধারণত সানেম গবেষণা সহযোগি/গবেষণা সহকারি পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে। ৫) পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পি আর আই) পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সিনিয়র বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদদের দ্বারা। ম্যাক্রোইকোনমি’র পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। রিসার্চ এসোসিয়েট ও এনালিস্ট পদে তারা ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশের স্থানীয় গবেষণা সংস্থার মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করছে – পাওয়ার এ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ই আর জি) বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বি এফ টি আই) ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (ডি আর আই) স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করার আগ্রহ থাকলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করতে পারেন কয়দিন পরপরই। তাতে জানা যাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ধরণ, তাদের এ পর্যন্ত করা কাজের প্রোফাইলসহ অন্যান্য তথ্যসমূহ। ঘাটাঘাটি করতে করতে পেয়ে যেতে পারেন এই তালিকায় যোগ করার মতন আরও ভালো কিছু প্রতিষ্ঠানের খোঁজও! (চলবে) পরের পর্বে পড়ুনঃ গবেষণা পেশায় অর্থনীতির শিক্ষার্থীরা- ২য় পর্ব
1 Comment
jannat
7/21/2021 01:57:49 pm
It was quite informative..I was searching for such precise information.thanks for sharing vya..
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |