জিনাত জাহান খান “গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাব অঙ্ক কষে বলে দিতে পারি, তবে মানুষের পাগলামি বুঝতে পারলাম না”, উক্তিটি গতিসূত্রের আবিষ্কারক স্যার আইজাক নিউটনের। প্রায় ৩০০ বছর আগে ১৭২০ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ লোকসানের শিকার হলে অনেকেই তাঁর কাছে জানতে চায় যে, তিনি একজন বিজ্ঞানী হয়েও শেয়ারের দামের ভবিষ্যৎ বুঝতে অপারগ হলেন কী করে, নাকি তিনি অঙ্ক কষতেই ভুল করেছেন। আর এরই জবাবে স্যার নিউটন উপরোক্ত কথাটি বলেন। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে লন্ডনভিত্তিক ‘সাউথ সি' কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে তাঁকে এই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তাঁর লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার পাউন্ড, যা আজকের বাজার মূল্যে প্রায় ২৬ কোটি পাউন্ড হবে। নিউটনের মতো হাজার হাজার মানুষের স্বপ্নের উপর নির্ভর করেই মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে সাউথ সি কোম্পানির শেয়ার দর ১২৮ টাকা থেকে হাজার পাউন্ডে উঠে যায়। লাগাতার উত্থানের পর হঠাৎ করেই ধস মানে শেয়ারবাজারে। ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১০০ পাউন্ডের ঘরে নেমে আসে সাউথ সি কোম্পানির শেয়ার দর। কোম্পানিটি বুদ্বুদের মতো ফেটে যাওয়ায় সেই সময়ে অনেকেই দেউলিয়া হয়ে যায়। বিশ্বের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে এই ঘটনাটি ‘দক্ষিণ সাগর বুদ্বুদ’ বা ‘সাউথ সি বাবল' নামে কুখ্যাত। অবশ্য সাউথ সি কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করার পেছনের উদ্দেশ্যটা ইতিবাচকই ছিল। ১৭১০ সালে ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ইউরোপের দুটি যুদ্ধ একাই লড়ছিল ব্রিটেন। এক্ষেত্রে অর্থ যোগান দেওয়ার সকল দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। রবার্ট হার্লের কমিটি রাজকোষের দায়িত্বে আসলে লক্ষ্য করেন যে, যুদ্ধসহ বাকি সব খরচের ভার সামলাতে গিয়ে ৯০ লাখ পাউন্ডের দেনা হয়ে গেছে। তবে এই বিষয়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কোনো ভ্রূক্ষেপই ছিল না। এমনকি সরকারের কাছে এই ঋণ পরিশোধ করার জন্য কোনো রোডম্যাপও ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর জন্য নতুন করে তিন হাজার পাউন্ডের ব্যবস্থা করা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কাজে সরকার একদমই সন্তুষ্ট ছিল না, তবে ব্যাংকটি ১৬ বছর আগে যে প্রাইভেট কোম্পানির সনদ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সেটার শর্ত মোতাবেক নতুন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। ফলশ্রুতিতে, রবার্ট হার্লের নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। তবে হার্লে হাল ছাড়লেন না। ১৭১১ সালে তিনি একটি বিকল্প পরিকল্পনা করলেন। সোর্ড ব্লেড কোম্পানির সাবেক পরিচালক জন ব্লান্টকে নিয়ে একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। এই কোম্পানিই সেই ‘সাউথ সি’। এই কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য ছিল ঋণদাতাদের কোনোভাবে সন্তুষ্ট করা। এজন্য সরকার তাদেরকে এই কোম্পানির শেয়ার অফার করে। এর সাথে সরকার তাদের ঋণের বিপরীতে ৬ শতাংশ হারে সুদ দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয়। অবশ্য, ঋণের জন্য যে পরিমাণ সুদ পাওয়ার কথা ছিল সেটা বিবেচনা করলে এই সুদের পরিমাণ ছিল অনেক কম। তবে কোম্পানির অফার লাভজনক মনে হওয়ায় তারা অফারটি মেনে নেন। সরকার নিজের ঋণের বোঝা সামলাতে সাউথ সি কোম্পানিকে দক্ষিণ আটলান্টিকের তীরবর্তী স্পেনীয় উপনিবেশগুলোতে একচেটিয়া ব্যবসা করার অধিকারও দিয়ে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতোই ছিল এই একচেটিয়া ব্যবসা। সাউথ সি কোম্পানির ভাগ্য প্রথমদিকে বেশ ভালোই ছিল। কোনো ঝামেলা ছাড়াই শেয়ারের ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছিল। ব্রিটেনের অধিবাসীদের হাতে সেই সময়ে টাকা-পয়সাও যথেষ্ট ছিল, আর তারা বিনিয়োগ করতেও ইচ্ছুক ছিলেন। ডিভিডেন্ড ইল্ড বিবেচনায় এটি একটি ভালো বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে প্রমাণিত হয়। তাছাড়া সরকার কোম্পানিটিকে একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার দিলে সবাই এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো আশাবাদী হয়ে উঠে। তবে দুই বছরের মাথায় সাউথ সি অঞ্চলের সাথে ব্যবসা করার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়লে বিনিয়োগকারীদের আশা ভঙ্গ হয়। ১৭১৩ সালের ইউট্রেখট চুক্তির ১ শতাংশও নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় ব্রিটেন। প্রথমদিকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটু হতাশা থাকলেও ১৭২০ সালে কোম্পানির শেয়ার দর ১২৮ থেকে ১ হাজার ৫০ পাউন্ডে উঠে গেলে সেই হতাশা অনেকাংশেই কেটে যায়। এমনকি শেয়ারের চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে কোম্পানি মানুষদের শেয়ার কিনতে সহায়তা করার জন্য ঋণ দিতে শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যেই কোম্পানির বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মূল উদ্যোক্তারাই গোপনে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করে। ১৭২০ সালের আগস্টেও হাজার পাউন্ডের উপরে কেনাবেচা করা হয় সাউথ সি কোম্পানির শেয়ার। মার্জিন ঋণে যারা শেয়ার কিনেছিলেন তাদের প্রথম কিস্তি পরিশোধের সময়ও চলে আসে। তবে সেই সময়ে একদিকে আমস্টারডাম শেয়ারবাজারেও ধস নামে, অন্যদিকে ফ্রান্সের মিসিসিপি স্কিম নিয়ে হতাশার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সেপ্টেম্বরেই শেয়ারের দর দেড়শ পাউন্ডে নেমে আসে। ডিসেম্বরে ১০০ পাউন্ডের কিছু উপরে লেনদেন হলেও ১৭২১ সালে এর মূল্য ৮০ পাউন্ডে নেমে যায়। সবার আগে দেউলিয়া হয় মার্জিন ঋণধারী স্পেকুলেটররা। সর্বহারা হয়ে অনেকে ব্রিটিশই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কোম্পানির করুণ অবস্থা দেখে ১৭২০ সালের ডিসেম্বরেই জরুরি অধিবেশন ডাকে হাউজ অব কমন্স। আর এর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ঠিক পরের বছরই। রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্তত তিনজন মন্ত্রী কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নেন। সাউথ সির সাথে জড়িত অনেক এমপি কোম্পানির শেয়ারদর তাদের অনুকূলে আনার জন্য মন্ত্রীদের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে উৎসাহ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সাউথ সি কোম্পানির পরিচালকদের গ্রেফতার করা হয় এবং শেয়ারগুলো ব্যাংক অব লন্ডন ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। অবশ্য এরপরেও কোম্পানিটি আরো এক শতাব্দী টিকে ছিল। শেয়ারবাজারে লেনদেন করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো ‘স্পেকুলেশন’ বা ‘ফটকাবাজি’। অনেক সময় স্পেকুলেট বা অনুমান করে শেয়ারের দর বুঝতে পারা সম্ভব হয় না। আর এর মধ্যে দুর্নীতি ও কারচুপির মতো বিষয়গুলো ঢুকে গেলে তো এর ভবিষ্যৎ বোঝা অসম্ভব। আর এমনটাই ঘটেছে সাউথ সি কোম্পানির ক্ষেত্রে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |