মাহজাবিন রশীদ লামিশা পানির পরে চা-কেই বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। শীতপ্রধান ইউরোপ কিংবা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা মধ্য এশিয়া- নানা রকমে, নানা প্রকারে চায়ের প্রচলন আছে সারা বিশ্বব্যাপীই। চা নিয়ে তাই আছে ব্যাপক রোমান্টিসিজমও। পারিবারিক আড্ডা থেকে বিশ্ব নিয়ে আলোচনা, সবখানেই চা কিন্তু চাই-ই চাই। অথচ এই জনপ্রিয় পানীয়ের সাথে জড়িত যে শ্রমিকরা, তাদের ন্যায্য মজুরির অভাব কিংবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা জীবনের গল্প অনেকটাই বয়ে গেছে সাধারণ মানুষের অন্ত্যরালে। এর পেছনে আছে সাধারণ জনজীবন থেকে দূরে থাকা, অধিকার সচেতনতার অভাব কিংবা চায়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের স্বার্থের মত অনেকগুলো কারণ। কিন্তু প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই নিপীড়নের সবচেয়ে বড় বলি চা শ্রমিকেরা, তাদের স্বপ্ন আর সুস্থ জীবনযাপন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বংশ-পরম্পরায় চলা নিপীড়ন ও শোষণইতিহাস অনুযায়ী, ১৮৪০ সালের দিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রথম চা চাষ শুরু করে ব্রিটিশরা। প্রথম দিকে অভিজ্ঞতা ও পারদর্শীতার জন্যে চাইনিজ শ্রমিকদের নিয়োগ করা হলেও, আবহাওয়াগত কারণে তারা এই দেশের সাথে মানিয়ে উঠতে পারছিলো না। ফলে দেশের মধ্যেই চা চাষী তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। মূলত কৃষিকাজের পরে অতিরিক্ত যেসব শ্রমিক কৃষি খাতে কাজ পেতো না মূলত তাদের থেকেই এই কাজের জন্যে লোক নিয়োগ করা হতো। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার মানুষ এই কাজে বেশি যুক্ত হয়ে পড়ে। চা শ্রমিকদেরকে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো মূলত চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করতো। এই প্রক্রিয়ায় মালিক শ্রেণির ব্যাপক লাভ হলেও শ্রমিকরা শোষিত হতো ভয়াবহভাবে। এর বাইরেও তাদের নানা রকম মিথ্যা লোভ ও প্রতারণার মাধ্যমে এই কাজে আনা হতো। ফলে সব দিক থেকেই শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিলো শুরু থেকেই। ব্রিটিশদের সময় থেকেই নানা আইন ও চুক্তির মারপ্যাচে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের রাস্তাও ছিলো বন্ধ। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দেয়া হয় তখন শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে নিজেদের পৈতৃক এলাকায় ফিরে যেতে চাইলে মালিকপক্ষ রেলের সাথে চুক্তি করে তাদের কাছে টিকেট বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এ ঘটনা ‘সিলেট চা শ্রমিক আন্দোলন’ নামেই ইতিহাসে পরিচিত। ঘটনাক্রমে এই শোষণের চক্র চা শ্রমিকদের উপরে চলছে প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে। সঠিক মজুরির অভাব তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনকে বাঁধাগ্রস্থ করেছে স্বাভাবিকভাবেই। দুবেলা অন্ন জোগাড়ের চিন্তায় তাদের সন্তানদের ভাল শিক্ষার ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়নি। ফলে প্রজন্ম ধরে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হওয়ার সুযোগই পাননি বেশিরভাগ শ্রমিকরা। তারা সুযোগের অভাবে বংশপরম্পরায় আবারও নিয়োজিত হয়েছেন এই একই পেশায়, মেনে নিয়েছেন তাদের পূর্বপুরুষের একই দুর্ভাগ্য। এসকল অঞ্চলের মানুষ যারা তৎকালীন সামাজিক প্রথায় নিচু গোত্রীয় ছিল তাদেরকে নানারকম মিথ্যা আশা দেখিয়ে প্রলুব্ধ করেই মূলত এই কাজে আনা হয়। পরবর্তীতে এইসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হলেও কাঠামোগত কারণে তাদের পক্ষে আর প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না। প্রাচীন দাস প্রথার এক নতুন রূপ হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের চা শ্রমিকরা। অত্যাচার, নিপীড়ন, আর মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে অন্যের দ্বারা শাসিত হওয়াই তাদের ভাগ্য হয়ে ওঠে বংশপরম্পরায়। পরিসংখ্যান, হিসাব আর ব্যবসায়িক প্রচারের ফলে চা বাগান সাধারণ মানুষের কাছে এই দেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে পর্যটক আকর্ষণ, অন্যদিকে প্রায় ১৬৭টির মত টি এস্টেট নিয়ে গড়ে ওঠা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদনের গৌরব- সব মিলিয়ে চা শিল্প আমাদের জন্যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা যারা সচল রাখেন চা চাষ ও তা সংগ্রহ করে, এই অর্থনীতির চাকার তলায় পিষ্ট হতে হয় সেই সকল শ্রমিকদেরই। সংখ্যার হিসাবের চা বাগান মালিকদের লাভের অংক যখন কোটির খাতা ছুঁইছুঁই তখনও এদেশের চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। রাজধানীর বহু বিলাস-বহুল খাবারের দোকানে এক কাপ চায়ের মূল্যের চেয়েও কম টাকা দৈনিক উপার্জন নিয়ে নীরবে নিপীড়িত হচ্ছেন দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির একাংশ। এরপর ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে কাজের সামান্য ভুল কিংবা ওজনে কম বেশি হলে অনেকসময় এই সামান্য মজুরি থেকেও কেটে রাখা হয় কিছু অংশ। চা ব্যবসার প্রসার যত দ্রুতই হোক না কেন, শ্রমিকদের মজুরির পরিবর্তনের বেলায় মালিক পক্ষের আঠারো মাসেই বছর হয়। একই সাথে শ্রমিক ইউনিয়নের জোরালো ভূমিকার অভাবকে স্বাভাবিকভাবেই শোষকগোষ্ঠী ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে। ফলে ভাগ্য বদলায় না সাধারণ চা শ্রমিকদের, পূর্বপুরুষের দূর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিজেরাও কাঁটায় ভয়াবহ কষ্টের জীবন। দারিদ্য-সীমার নিচে থাকা ভয়াবহ জীবন দিনে দুইবেলা ভাত জোগাড়ও তাদের সম্ভব হয় না। অনেকসময় খাবারের অভাবে তারা সেদ্ধ চা পাতা খেয়েও জীবন ধারণ করে। সাধারণ ছনের ঘর আর সামান্য রেশন সব মিলিয়ে তাদের যে মানবেতর জীবন একই টি এস্টেটের বড় বড় কর্মকর্তাদের বিলাস বহুল জীবনের দিকে তাকালে চলমান শোষণ আর প্রাচীন দাস প্রথার কথাই মাথায় আসে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস এর তথ্যানুযায়ী, সিলেটের চা শ্রমিকদের ৭৪% ই বাস করে দারিদ্র্যসীমারও নিচে। যাদের দৈনিক আয় কোনোরকমে ১০০ কাছাকাছি তাদের সন্তানদের জন্যে শিক্ষা কিংবা সঠিক চিকিৎসা সবই উচ্চাভিলাষ। ফলে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগও সামান্য। একশো বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে চা বাগানের মধ্যে থেকে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার হার এখনও নগন্য। সংসারের হাল ধরতে বেশিরভাগ স্কুলে যাওয়ার বয়সের শিশুরাও আবার যুক্ত হয় এই একই কাজে। পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকা, ঘন ঝোপের মাঝে কাজ করার ফলে এখানকার চা শ্রমিকদের থাকে উচ্চ স্বাস্থ্য ও মৃত্যু ঝুঁকি। কিন্তু যাদের সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মূল্য মাত্র ১২০ টাকা তাদের জন্যে ভালো হাসপাতাল বা চিকিৎসার ব্যবস্থা যে নেই এটাই কঠিন বাস্তব। পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের অভাবে এখানকার শিশু, নারী ও পুরুষ সকলেই ভোগেন পুষ্টিহীনতা ও নানা শারীরিক জটিলতায়। যদিও নিয়মানুযায়ী মালিক পক্ষের তরফ থেকে চিকিৎসা ভাতা ও সুবিধা শ্রমিকদের পাওয়ার কথা কিন্তু ন্যায্য মজুরির মত তাদের এই পাওনাও এত বছরেও থেকে গেছে অধরা স্বপ্নের মতই। এখানকার নারীদের জন্যে নেই কোনো সঠিক মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নেই উপযুক্ত মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা। পরিচ্ছন্ন প্রজনন স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা, নিজেদের নিরাপত্তা ও মানসিক সুস্থতা- কোনো রকম সুযোগ সুবিধাই দেয়া হয় না এখানকার শ্রমিকদের। শ্রমিক আইনে যদিও বা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা থাকাকে কর্মক্ষেত্রের অতীব জরুরি বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার চিহ্নও নেই কোথাও। ফলে কাজের জায়গা কিংবা নিম্ন আয়ের বাসস্থানে কোথাও-ই শ্রমিকরা পাননা স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা। এর পরিণতিতে তারা আক্রান্ত হন নানারকম জটিল রোগে, অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে এই জটিল রোগ নির্ণয়ও হয় না। সকলের অজান্তেই নানা জটিলতায় অকালে মারা যান তারা। পরিসংখ্যানের হিসাবে চা বাগানের নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই কিডনি, মূত্রথলি কিংবা মূত্রনালীর সমস্যায় ভুগছেন, অনেকের ক্ষেত্রে এই সমস্যা জরায়ু পর্যন্তও ছড়িয়ে পড়ে। ১০ টি চা বাগানের ৩০০০ শ্রমিকের ওপর করা পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় ৫১৯ জন শ্রমিক জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর বাইরেও যৌতুক, বাল্য বিবাহ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতার মত ঘটনাও এখানে ঘটে প্রতিনিয়ত। ২০১৯ সালের এক জরিপে দেখা যায় চা বাগান ও সংলগ্ন এলাকায় বাল্য বিবাহের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ, যার মধ্যে ২২.২ শতাংশ কন্যা শিশুই অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদান করেন। ফলে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর উচ্চহার দেখা যায় তাদের মাঝে । শিক্ষা- সংস্কার ও আইনের অভাবে এখানকার মানুষ এখনও পিছিয়ে আছে সবদিকেই। দুর্ভাগ্যবশত ও অধিকার সচেতনতার অভাবে পাহাড়ের ঢালে লোকচক্ষুর অন্তরালে বছরের পর বছর ধরে চা শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে সব রকম মৌলিক অধিকার থেকে। অর্থনীতির হিসাবে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার পথে অগ্রসর হওয়া বাংলাদেশেরই একাংশের মানুষের জন্যে এখনও সামান্য ডাল-ভাত বিলাসিতার সামীল। কিন্তু চা বাগানের অপূর্ব সৌন্দর্য আর চা প্রেমের মধ্যে তাদের আর্ত চিৎকার চা বাগানের বাইরে আসার সুযোগই পায়নি শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে। অভিজাত শখের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তাদের করুণ জীবনের চিত্র। চলমান পরিস্থিতি ও আন্দোলনযুগ যুগ ধরে নিপীড়িত হতে থাকা চা শ্রমিকরা একরকম বাধ্য হয়ে নিজেদের বাঁচানোর আন্দোলনে নামে এই বছরের আগস্ট মাসে। প্রাথমিকভাবে ৯ আগস্ট থেকে সপ্তাহে চারদিন ২ ঘন্টা কর্মবিরতি পালনের মাধ্যমে এই আন্দোলন শুরু হলেও ১৩ তারিখ থেকে তা পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে রূপ নেয়। চা শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি তাদের দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে অন্তত ৩০০ টাকা করা। কেবল মুখের কথায় নয় বরং ৩০০ টাকার এই দাবি মেনে নিয়ে তাদের মজুরি নিশ্চিত হলে পরেই চা শ্রমিকরা কাজে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। দুঃখজনক হলেও এই আন্দোলনই একরকম তাদের সাথে হয়ে আসা এতদিনের নির্যাতনকে তুলে ধরে সাধারণ মানুষের কাছে। চা নিয়ে এত আলোচনা হলেও সংবাদ মাধ্যম কিংবা যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের এই দৈন্যদশার সংবাদ ব্যাপকভাবে উঠে আসে এই আন্দোলনের ফলেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয়বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর মধ্যে দিয়েই চা শ্রমিকদের অধিকারগুলোও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চা বাগানের এই শ্রমিকদের জন্যে এই আইনের সুষ্ঠ ব্যবহার ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি এবং এগুলোকে বাস্তবায়ন করার যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া হয়নি- দুটোই সত্য। তবে এখনকার আন্দোলনের পরে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণ হওয়া উচিৎ সকলেরই লক্ষ্য। বাংলাদেশের শ্রম আদালত ও শ্রম আইনের আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এর বাইরে প্রয়োজন চা শ্রমিকদের আরো সংগঠিত করা যেনো তাদের অধিকারগুলোকে মালিকপক্ষ অন্যায় ভাবে নাকচ না করতে পারে। সঠিক বেতন কাঠামো ও নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে বেতন বৃদ্ধির মত সময়োপযোগী পদক্ষেপগুলো নেয়ার জন্যে এটিই সবচেয়ে ভালো সময়। তাই সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ ও সকলের সহযোগিতা ও পদক্ষেপের ফলে নিশ্চিত হবে চা শ্রমিকদের মৌলিক দাবি পূরণ ও তাদের মানবিক অধিকার আদায় এটিই এখন সকলের কাম্য। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পকে চালনা করে চলেছেন যে গোষ্ঠী তাদের উপর হওয়া দীর্ঘসময়ের এই নিপীড়ন থেমে নিশ্চিত হোক তাদের ন্যায্য মজুরি, সুস্থ জীবন, সুন্দর ভবিষ্যত। তথ্যসূত্র
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |