তানজিম-উল-ইসলাম ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। প্রায় নয়মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হন, ২ লক্ষ নারী ধর্ষিত হন এবং বাংলাদেশ পরিণত হয় এক ধংসস্তূপে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশের সকল অবকাঠামোই ভেঙ্গে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। তার মধ্যে বেশ কিছু সমস্যার এখনো মীমাংসা হয়নি। যুদ্ধবন্দী বিনিময় যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যে প্রধান সমস্যা ছিল যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান উভয় দেশেই পাকিস্তানি এবং বাঙালি যুদ্ধবন্দী আটক ছিলেন। এমতাবস্থায় পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে কোন সংলাপ সম্পাদনও সম্ভব ছিল না। ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ এবং ভারত এক যৌথ ঘোষণায় জানায় যে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ স্বীকৃতির প্রশ্ন বাদ দিয়েই যুদ্ধবন্দীদের বিষয়টি সমাধান করতে বদ্ধ পরিকর। একই ঘোষণায় তারা এটাও উল্লেখ করেন যে ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। পরবর্তীতে ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের সংসদে দাঁড়িয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওআইসি সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তানে যান। ভারতের দিল্লিতে ’৭৪ সালের ৫-৯ এপ্রিল বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের বিষয়ে চুক্তি সম্পন্ন হয়। ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে তিন দেশই একমত হয় যে জাতিসংঘের সংজ্ঞানুযায়ী তারা নৃশংস যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়েছিল। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। চুক্তিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো অতীতের “ভুল” ভুলে গিয় বাংলাদেশকে ক্ষমা করে দিতে বলেন। পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে বাংলাদেশ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়। এত বছর পরেও ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এখনো ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী বিচারের কোন সুরাহা হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান যে দিল্লি চুক্তির পরও পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার এখতিয়ার বাংলাদেশের রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে জীবিত যুদ্ধাপরাধীদের ফেরত চাইবে। বিহারী শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ও অধিকারঃ বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারী শরণার্থীদের গ্রহণের বিষয়েও এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় তিন লক্ষ উর্দুভাষী বিহারী ছেষট্টিটি ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছেন। বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়ায় তারা বিভিন্ন ধরণের সুযোগসুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। ২০০৮ সালে এক রায়ে বিহারীদের এ দেশের নাগরিকত্ব দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অবশ্য এরপরও সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয়নি। এর মূল কারণ হল, প্রবীণ বিহারীরা এখনো পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। সেজন্য, তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহী নন। তাঁরা এখনো পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান। তবে পাকিস্তান সরকার কবে নাগাদ এই নাগরিকদের ফেরত নেয়া হবে সেই বিষয়টি পরিস্কার করেনি। তাছাড়া, ২০১৬ সালে প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হলে বিহারীরা আবার নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। নতুন আইনের ৪(২) উপধারায় বলা হয়েছে, কারও পিতা বা মাতা বিদেশি শত্রু হলে তিনি জন্মসূত্রেও নাগরিক হতে পারবেন না। ক্ষতিপূরণ দাবি পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান বাংলাদেশের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদ জব্দ করেছিল বলে ২০০২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার দাবি করে। পরবর্তীতে বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা এবং সম্পদ ধংসের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। তিনি জানান যে বাংলাদেশের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে চারটি আলাদা দাবি রয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণের অর্থ কিস্তিতে পরিশোধ করার কথাও প্রস্তাব করেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার কোন ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়নি। বরং ২০১৬ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবি করে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে পাকিস্তানের বাংলাদেশ থেকে পাওনা রয়েছে। এজন্য তাঁরা বাংলাদেশের কাছ থেকে নয় বিলিয়ন রুপি ক্ষতিপূরণ দাবি করে। এই দাবিটি অর্থমন্ত্রী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরেও বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মাঝে বিদ্যমান দূরত্বের কারণ উপর্যুক্ত মানবিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলো। এ সকল সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যকার কূটনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন সম্ভবপর হবে না।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |