নিশাত তাসনিম ইতিশা, মোহাম্মদ ইফতেখারুল ইসলাম, নুমায়ের আহম্মেদ অর্থনীতিকে সাধারণত একটি দুর্বোধ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। জটিল তাত্ত্বিক এবং গাণিতিক সমস্যা দিয়ে ভরপুর এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। এটি অধ্যয়নের মাধ্যমে যেমনি মানব- আচরণকে ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনি বিশ্লেষণী ক্ষমতাও বেড়ে যায়। অর্থনীতির একটি বিশেষ শাখা হলো রাজনৈতিক অর্থনীতি। রাজনৈতিক অর্থনীতি বোঝার জন্য সর্বপ্রথম কাজ হলো বই পড়া। এমন অনেক বই রয়েছে যেগুলো পড়লে রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ করা সম্ভব। সেরকমই আটটি বই নিয়ে আমাদের দ্বিতীয় পর্বের লেখা। Who Rules the World - Noam Chomskyনোয়ান চমস্কি একজন মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি একাধারে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) এবং আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে উঠে এসেছে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্যের কথা। লেখক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব-রাজনীতি বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের তুমুল সমালোচনা করেছেন, পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের বিকাশের মাধ্যমে মার্কিন আধিপত্যের ব্যাপারটিকেও তুলে ধরেছেন। কিভাবে রাজনীতি এবং অর্থনীতির মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গড়ে উঠছে- এই প্রশ্নের উত্তরটি এই বইয়ের মধ্যে পাওয়া যায়। ৩২০ পৃষ্ঠার এই বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পেয়েছে। তাছাড়াও এই বইটি বিজনেসউইক, বোস্টন গ্লোব, দ্যা নিউ-ইয়র্কার সহ আরো অনেক জায়গায় প্রশংসিত হয়েছে। The Road to Serfdom- Friedrick Hayek১৯৭৪ সালে নোবেল পুরষ্কারজয়ী এংলো- অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক হায়েকের এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে। তিনি এই বইতে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন, পাশাপাশি মুক্তচিন্তা এবং অর্থনীতিতে ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিষয়টির পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লিখিত গ্রন্থটিতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন পশ্চিমা সরকারগুলোর সমাজতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা এবং ফ্যাসিবাদের পতনের কাহিনী। লেখকের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সঠিক যুক্তি দেখানো এবং পুঁজিবাদের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা। তার মতে, ফ্যাসিবাদ এবং সমাজতন্ত্র, দুটো মতবাদেরই ভিত্তি একইরকম, এবং সেটা একনায়কতন্ত্রের পথ সুগম করে। ২৬৬ পৃষ্ঠার এই বইটির দুই মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রিত হয়েছে। ন্যাশনাল রিভিউ ম্যাগাজিনের করা " বিংশ শতাব্দীর সেরা ১০০ টি নন-ফিকশন " বইয়ের তালিকাতেও এই বইটি স্থান পেয়েছে। Globalisations and Its Discontents- Joseph Stiglitz কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ২০০১ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের লেখা এই বই প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। এই বইয়ে লেখক তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছেন মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন নীতি যেমন- মুক্তবাজার,বেসরকারিকরণ,মুক্তবাণিজ্য প্রভৃতি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির জন্য কেন মঙ্গলজনক নয় এবং তুলে ধরেছেন উন্নয়নশীল দেশসমূহ কেন বিশ্বায়ন নিয়ে অসন্তুষ্ট। এছাড়াও তিনি পূর্ব এশিয়া,আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য আইএমএফ বা ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড সংস্থার বিভিন্ন নীতিকেও দায়ী করেন। Outliers: The Story of Success- Malcolm Gladwellকানাডিয়ান সাংবাদিক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের লেখা এই বই প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। এই বইতে লেখক উচ্চস্তরের সাফল্যের পিছনে অবদানকারী বিষয়গুলো নিয়ে পরীক্ষা ও ব্যাখ্যা করেন। তিনি সাফল্যের পিছনে মূলত তিনটি বিষয়কে দায়ী করেন। প্রথমত,ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী তার প্রতিভার মাত্রা নির্ধারিত হয়। দ্বিতীয়ত,উচ্চাকাঙ্ক্ষীর জন্য প্রচুর সৌভাগ্যের প্রয়োজন। কেননা শুধুমাত্র প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রমে সফল হওয়া যায় না, এর সাথে সৌভাগ্যেরও প্রয়োজন। তৃতীয় বিষয়টি হল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার,যা ব্যক্তি তার সমাজ থেকে পেয়ে থাকে এবং যার মধ্যেই অধিকাংশ সৌভাগ্যই নিহিত। এছাড়াও লেখক এই বইয়ে "10,000-Hour Rule" নামে একটি নিয়ম তুলে ধরেন যেখানে ব্যাখ্যা করেছেন কোন কাজে সুদক্ষ হতে হলে কেন তাতে অন্তত ১০,০০০ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়। ৩০৪ পৃষ্ঠার এই বই ২০০৮ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পায়। Sapiens: A Brief History of Humankind- Yuval Noah Harariইউভ্যাল নোয়াহ হারারির লেখা এই বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। তিনি একজন ইসরাইলি ঐতিহাসিক,কাজ করেছেন হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার এই বইটি চীনের ন্যাশনাল লাইব্রেরি কর্তৃক প্রদত্ত "Wenjin Book Award" এর জন্য মনোনীত হয়। এই বইটিতে মূলত উঠে এসেছে মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল বিষয়ের ইতিহাস। এই বিষয়সমূহ জীববিজ্ঞান থেকে শুরু করে দর্শন,ধর্ম,কৃষি,সমাজবিজ্ঞান,মনোবিজ্ঞান,অর্থনীতি,ব্যবসা,যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে শুরু করে আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। মানুষ হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্সের যাত্রার শুরু থেকে একের পর এক বাধা পেরিয়ে কিভাবে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছালো এবং বর্তমান মানুষের ভবিষ্যতই বা কি হতে পারে সেসব বিষয় ৪৫০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে লেখক অত্যন্ত সহজপাঠ্য ভাষায় তুলে ধরেছেন। এই বইটি দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল,দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট,দ্য গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রশংসিত হয়েছে। The Undercover Economistটিম হারফোর্ড ফাইনান্সিয়াল টাইমসের একজন সিনিয়র কলামিস্ট । তিনি তার দীর্ঘস্থায়ী চলমান কলাম "দ্য আন্ডারকভার ইকোনমিস্ট" এ প্রতিদিন তার অর্থনৈতিক ধারণা প্রকাশ করেন। এরপর ২০০৫ সালে বই আকারে প্রকাশ পায়। তার প্রথম বই "দ্য আন্ডারকভার ইকোনমিস্ট" ৩০টিরও বেশি ভাষায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ১.৫মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। এ বইটি পড়লে অর্থনীতির মৌলিক ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া বইটি অর্থনীতির বিভ্রান্তিকর সূত্র, গ্রাফ, চার্ট ব্যাখ্যা করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি: অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম. এম. আকাশ দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণা করছেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত "বাংলাদেশের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত" এ তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন। পাক-বৃটিশ শাসনামল, বৃটিশ শাসনামল, পাকিস্তান শাসনামলের বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন বইটি পড়লে জানা যায়, তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থারও ধারণা পাওয়া যায়। অর্থনীতিশাস্ত্রে দর্শনের দারিদ্র্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাত এই বইয়ে মূলত আলোচনা করেছেন অর্থনীতিশাস্ত্র প্রকৃতিবিজ্ঞান নয়, বরং তা হলো নীতিশাস্ত্র। দীর্ঘকাল সুনীতিশাস্ত্রীয় বিষয় থেকে ক্রমে তা রূপ নিয়েছে দর্শনের মহাদারিদ্রে। এই বইয়ে তিনি বিগত আড়াই হাজার বিছরের বিভিন্ন বিষয়াবলি আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে কিছু দিক নির্দেশনা উপস্থাপন করেছেন।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |