ইএসসি ব্লগ সম্পাদকীয় প্যানেল আজ বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫০তম বিজয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে ঠিক এই দিনে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক সামরিক বিজয় অর্জন করে। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিপূর্ণ হয়। নিজ ভূখন্ডে পূর্ণ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে আবারো স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পর নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া সেদিনের বাংলাদেশের সাথে আজকের বাংলাদেশের রয়েছে বিস্তর তফাৎ। যুদ্ধবিধ্বস্ত হতদরিদ্র অবস্থা থেকে অর্ধশতাব্দী পরে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। বেড়েছে শিক্ষার হার, গড়ে উঠেছে ব্যবসা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান। অধিকাংশ অবকাঠামো যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধেরও ব্যাপক পরিবর্তন সাধন হয়েছে। আজকের প্রজন্মের অধিকাংশের কাছে স্বাধীনতা শুধুই ইতিহাস। তার বিপরীতে পূর্ববর্তী প্রজন্ম পরাধীন ও স্বাধীন দুটি সময়ই পার করেছে। তাই দৃষ্টিভঙ্গিগত জায়গা থেকেও দুটি প্রজন্মের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মাথায় রেখে পরিচালিত হয়েছে। শুধু পাকিস্তানের থেকে মুক্ত হওয়াই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল না। একটি শোষণ বিহীন ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল পুরো সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের থেকে স্বাধীন হওয়া ছিল তার একটি অংশ মাত্র। এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ’৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের দিকে তাকালে। সুস্পষ্টভাবে জাতীয় ৪টি মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনের দর্শনের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। একই সাথে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উল্লেখের মাধ্যমে আমাদের জাতিগত ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, শোষণবিহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্তিম উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ৫০ বছর পরে সেই প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির দূরত্ব কতটুকু তা সংক্ষেপে এই লেখায় খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে বাংলাদেশ গত ৪৯ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি হতাশাজনকই বলা যায়। এখানে বলে রাখা ভাল জাতীয় ঐক্য বলতে সাধারণভাবে সংবিধান ও আইনের প্রতি জাতিগত শ্রদ্ধা, জাতীয় ইতিহাসকে দলমত নির্বিশেষে ধারণ, জাতীয় পরিচয়ের উপর আস্থা, বহু মতের সহাবস্থান ও সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা কে বোঝানো হয়। এই ক্ষেত্রগুলো থেকে বিচার করলে বহু দিক থেকেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যেরকম ঐক্য ও সহাবস্থানের সাথে পরিচালিত হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সেরকম মসৃণ ছিল না। স্বাধীনতার দুয়েক বছর বাদেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সহাবস্থানের পরিবেশ বিনষ্ট হয়। বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডল অচিরেই সহিংস সংঘাতের উৎসে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতিগত ঐক্যের ওপর নানামুখী আক্রমণ আসে। জাতীয় সংগ্রাম ও ইতিহাসকে দলীয় মোড়কে উপস্থাপনেরও চেষ্টা করা হয়। একই সাথে বাড়তে থাকে সার্বভৌমত্বের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নানামুখী চাপের মুখে থাকার কারণে সুশাসন ব্যাহত হয়। চারিদিকে নেমে আসে অরাজকতা। জাতির পিতার হত্যার মাধ্যমে সেই অরাজকতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যায়। সেই দুঃসময়ের সুযোগ গ্রহণ করে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। গণতন্ত্রের বদলে প্রতিষ্ঠিত হয় একনায়কতান্ত্রিক শাসন। শুরু হয় এক অন্ধকার যুগ। যে যুগে ইতিহাস নিষিদ্ধ হয়, কণ্ঠ রোধ হয়, শোষণ রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারে পরিণত হয়। যদিও নব্বই এর দশকে কাগজে কলমে আমরা একনায়কতন্ত্র থেকে বের হয়ে আসি কিন্তু তবুও গণতন্ত্রায়ণের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা সন্তোষজনক নয়। এর কারণ নানামুখী। একে তো বহু বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ফলে উত্তর প্রজন্মের গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞা ও স্পৃহা আর আগের মত ছিল না। উপরন্তু, তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশের পক্ষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার বদলে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও বিরোধী পক্ষকে সমূলে উৎপাটনের সহিংস পন্থা বেঁছে নেয়। তাতে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা অনেকটা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যেখানে সম্মুখে থেকে জনগণকে প্রেরণা যোগানোর কথা সেখানে এসব দলীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বাধীনতার পরবর্তীতে বহুদলীয় গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে যে রিকনসিলিয়েশন বা পুনঃনির্মাণের মধ্য দিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে আজও বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সদম্ভে ঘুরে বেড়ায়, ইতিহাস নিয়ে উত্তর প্রজন্মের ঐক্য, শ্রদ্ধা ও জ্ঞান সন্দেহাতীতভাবে অপ্রতুল। ইতিহাসের রাজনীতিকরণ সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের যেই অন্যতম লক্ষ্য গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, তা থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনও আমরা বিচ্যুত। হতদরিদ্র থেকে উন্নয়নের পথে গত ৪৯ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি তা বললে মিথ্যে বলা হবে। স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতে বাংলাদেশ ছিল দারিদ্র্য পীড়িত, যুদ্ধবিদ্ধস্ত হতদরিদ্র একটি দেশ, না ছিল অবকাঠামো, না ছিল পর্যাপ্ত শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা। প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্যের কোঠায়। দুর্নীতি ও তীব্র অরাজকতা অর্থনীতির ওপর চেপে বসেছিল। সেখান থেকে আজকের বাংলাদেশ অনেকটাই বেড়িয়ে এসেছে বলা যায়। ২০১৮ সালের হিসাব মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৫% যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের তুলনায় বেশি। ২০১৮ সালের হিসাব মতে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ৭৩.৯১% ও মাথাপিছু আয় ১,৭৫১ মার্কিন ডলার যা আমাদের উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম বড় নির্ণায়ক। অবকাঠামোগত খাতেও গত এক দশকে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরী হচ্ছে যা অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। একই সাথে নির্মাণাধীন রয়েছে বৃহৎ বৃহৎ উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠের চিত্রে যদি তাকাই তাহলে একটি ভিন্ন দৃশ্যও দেখা যাবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শ্রেণি শোষণহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বাংলাদেশের গতি মন্থর। এত উন্নয়নের মাঝেও সমাজে আয় বৈষম্য দিনকে দিন বাড়ছে। উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় একটি গোষ্ঠী। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ আজও গুণগত শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও সুশাসন হতে বঞ্ছিত। দুরারোগ্য কোন রোগ হলেই গড়পড়তা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যায়। তাও অধিকাংশ সময়ে সুচিকিৎসা মেলে না। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার গুণগত মান কমেছে। সম্প্রতি ইউএনডিপি কর্তৃক প্রকাশিত ‘গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২০’-এ বাংলাদেশ ১৩৮ টি দেশের মধ্যে ১১২ তে অবস্থান করছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর থেকে পেছনে। এর থেকেই বোঝা যায় শিক্ষার মানের দিক থেকে বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে। চাকরি হারালে নেই রাষ্ট্র থেকে কোন সামাজিক নিরাপত্তার সু্যোগ। প্রতি বছর সময়মতো বেতন পাওয়ার জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়। কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তাও ঠিকমতো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। মানসম্মত খাদ্যদ্রব্যের দাম কৃষিক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। দুর্নীতির কারণে করের অর্থের একটি বিপুল অংশ অপচয় হচ্ছে। পাচার হচ্ছে লক্ষ্য কোটি টাকা বছরের পর বছর। ঋণখেলাপী কেলেঙ্কারিতে দেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যস্থ। এসকল অর্থ ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আজ দেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে থাকতে পারত! এসব দিক বিবেচনা করলে গত ৪৯ বছরে আমাদের যত উন্নয়ন করার কথা ছিল তার কিছুই আমরা করতে পারি নি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দূরত্ব যেন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতের পথে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই এদেশের বাঙালি জাতীয়তা, সংস্কৃতি ও ভিন্নমতকে স্বীকার করতে হবে। কারণ এই জাতীয়তা ও সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্যই ধর্ম, মত নির্বিশেষে সবাই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। তখনকার সকল অর্জন জাতীয় অর্জন ও সকল ত্যাগ জাতীয় ত্যাগ। এদেশটা এই ভূখণ্ডে জন্ম নেয়া ও বাস করা আমাদের সবার। একই সাথে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীও আমাদের সামষ্টিক সংগ্রামের অংশীদার। তাদের ওপরও জোর করে বাঙ্গালিয়ানা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের যথাযথ অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। সামাজিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে না পারলে অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন বাংলাদেশ নির্মাণ অসম্ভব। আশা করছি ভবিষ্যৎ বিজয় দিবসগুলোতে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের আদলে গড়া একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে পাব। বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |