লুবাবা মেহজাবিন প্রিমা; শাহরান হুসাইন দিল্লি থেকে স্যান ফ্রান্সিসকো, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য থেকে পপ তারকা রিহানার টুইট, সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ভারতের কৃষক আন্দোলন। ভারতের সংসদে পাস হওয়া কৃষি বিলের বিরুদ্ধে ভারতে আন্দোলনরত কৃষকদের সাথে ভারত সরকারের আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এরই মধ্যে নানা পক্ষ থেকে আসছে নানা অভিযোগ। এই আন্দোলনের কারণ, এর ঘটনাবলী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে আজকের এই ব্লগ। কৃষক আন্দোলনের পটভূমি: ভারতে কৃষি খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বেশ কিছু বছর ধরেই বিরাজমান। জমির মালিকানা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে যা কৃষকদের উৎপাদনশীলতা কে কমিয়ে আনছে। ঋণগ্রস্ত দরিদ্র কৃষকরা অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৯৫ ও ২০০৫ এর মধ্যে মোট ২,৯৬,৪৩৮ কৃষক আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কৃষি খাত ও কৃষকদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কৃষকদের মধ্যে রোষ ছিল। অপরদিকে, ২০০৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কৃষি খাতের পুনর্জীবনের জন্যে দ্বিতীয় গ্রিন রেভোলুশন প্রয়োজন আছে বলে উল্লেখ করেন। কৃষি খাতের বাণিজ্যিকীকরণ, ঋণ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কৃষকদের সর্বোচ্চ মূল্যে পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মনমোহন সিংয়ের এই কথার উল্লেখ করে বলেন মোদী সেই প্রস্তাবই বাস্তবায়িত করবেন। এরই মাধ্যমে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সংসদে পাস করা হয় তিনটি কৃষি বিল, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ভারতের সাধারণ কৃষকরা। ভারত সরকার তাদের অবস্থানে অটল থাকলে কৃষকরা রাস্তায় নামেন ও তাদের আন্দোলন চালিয়ে যান। ঘটনাপ্রবাহ: কৃষি আইনগুলো জনসম্মুখে আসার পর থেকেই পাঞ্জাবে আন্দোলন শুরু হয়। বিল পাসের পর ভারতজুড়ে কৃষকরা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ভারতের কৃষি ইউনিয়নগুলো ভারত বন্ধের ডাক দেয়। যার ফলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিল নাড়ু, ওড়িশা, কেরালাসহ দেশব্যাপী অবরোধ হয়। অক্টোবর থেকে শুরু করে দুই মাস ধরে পাঞ্জাবে রেল লাইন বন্ধ থাকে "রেইল রকো" কর্মসূচির আওতায়। ২৫ নভেম্বর কৃষকরা "দিল্লি চালো" কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দিল্লির মুখে মার্চ করেন। দিল্লি বর্ডারে তাদের সাথে উপর পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে। এছাড়া বর্ডারে ব্যারিকেড ও রাস্তা খনন করে রাখা হয়। ২৬ নভেম্বর ভারতের প্রায় ২৫ কোটি মানুষ কৃষি আইন ও শ্রম আইনের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার হরতাল পালন করেন। ধারণা করা হয়, ২৮ নভেম্বর ও ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ কোটি কৃষক দিল্লি অবরোধ করে রাখেন। ৩ ডিসেম্বর ভারত সরকার কৃষকদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও উক্ত আলোচনায় শুধু নির্দিষ্ট কিছু কৃষক প্রতিনিধির উপস্থিতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতির কারণে কৃষকরা আলোচনায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ৪ ডিসেম্বর কৃষকরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কর্পোরেট লিডারদের কুশপুত্তলিকা দাহ করার ঘোষণা দেয়। ৫ ডিসেম্বরে সরকারের সাথে তাদের আলোচনা আবারও অসফল হলে তারা ৮ ডিসেম্বর দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। ৯ ডিসেম্বর সরকার আইনে কিছু পরিবর্তন আনে, যা কৃষকরা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৩ ডিসেম্বর তারা দিল্লি - জয়পুর মহাসড়ক অবরোধ করে। এরই মাঝে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিরা আন্দোলনের সমর্থনে তাদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেবার ঘোষণা দেয়। ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকরা কৃষক প্যারেড আয়োজন করেন যেখানে তারা ট্র্যাক্টর, ঘোড়ায় ও পায়ে হেঁটে অংশ নেয়। রয়টার্স এর মতে, প্রায় ২ লাখ ট্র্যাক্টর উক্ত প্যারেডে অংশ নেয়। সিঙ্ঘু বর্ডার থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট একটি রুটে এই প্যারেড হবার কথা হলেও কৃষকরা একাধিক পথে যাত্রা করেন। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। এরই মধ্যে এক কৃষক নিহত হন। যদিও কৃষকরা দাবি করেন তিনি পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন, পুলিশের দাবি তার মৃত্যু ট্র্যাক্টর দুর্ঘটনায় হয়। এক পর্যায়ে কৃষকরা দিল্লির লাল কেল্লায় প্রবেশ করেন ও একজন কৃষক একটি পতাকাদণ্ডে ধর্মীয় পতাকা নিশান সাহিব উত্তোলন করেন। প্রজাতন্ত্র দিবসে জাতীয় পতাকা অবমাননা ও দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে কৃষকদের তুমুল সমালোচনা করা হয়। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি যারা এই আন্দোলনে কৃষকদের পাশে ছিলেন তারা নিজেদের সমর্থন সরিয়ে নেন। কিন্তু কৃষকরা তাদের অবস্থানে অটল থাকেন ও ব্যাখ্যা করেন নিশান সাহিব উত্তোলন মূল কর্মসূচির অংশ ছিল না এবং এই কাজ যিনি করেন তাকে আন্দোলন থেকে অনেক আগেই চ্যুত করা হয়েছে। তবুও সরকারের অবস্থান কঠোর হতে থাকলে অনেকেই মনে করেন আন্দোলন এর সমাপ্তি ঘটবে, কিন্তু তা হয়না। বরং উত্তর প্রদেশ থেকে জাট মহা পঞ্চায়েত এই আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু সরকার কৃষকদের উপর আরো কঠোর হয়। আন্দোলনের স্থানে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এই সংক্রান্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিবসহ আরো অনেকে। রাজনীতি ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: কেন্দ্রীয় সরকারের এই তিনটি আইনকে ভারতের বিরোধী দলগুলো আখ্যায়িত করেছেন “কৃষকদের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা” এবং সংবিধান বিরোধী হিসেবে। এই সংস্কারের ফলে রাজ্য সরকারের সকল কৃষি বিষয়ক ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে চলে গিয়েছে কেন্দ্র সরকারের হাতে, এমনটাই তাঁদের দাবি। কিন্তু সরকার পক্ষের বিশেষজ্ঞগণ দাবি করেন যে, কৃষি বিপণন উন্নয়নের জন্য মাইলফলক এই আইন। ভারতের পলিসি নির্ধারক সংস্থা “নীতি আয়োগের” প্রধান অমিতাভ কান্ত মতামত দিয়েছেন যে এই আইন কৃষি সংস্কার লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিলতা ও মান্ডি বিপণন ব্যবস্থার হাত থেকে কৃষকদের মুক্তি দিবে; এবং এ নিয়ে অপরাজনীতি কেবল দেশের উন্নয়নের পরিপন্থী। কৃষকদের এই দীর্ঘ আন্দোলন থামাতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় সয়ংসেবক সংঘ এখন মরিয়া; কেন্দ্র সরকার ১১ বার কৃষকদের সাথে বৈঠকের পরেও ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইনগুলোর বাস্তবায়ন ১৮ মাসের জন্য পিছিয়ে দিলেও তা মানতে নারাজ কৃষিজীবী আন্দোলনকারীরা। এর মাঝে দেশটির প্রধান বিচারপতি নারী ও বৃদ্ধ আন্দোলনকারীদের ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করায় নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের ওপর একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরির প্রস্তাবনা দিলেও অনেকের দাবি এটি সরকারের আইন বিভাগের ওপর বিচার বিভাগের অন্যায় হস্তক্ষেপ। মিডিয়া ও বিতর্ক: ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যম সরকারের প্রতি অনুগত থেকে সঠিক সংবাদ সরবরাহ করছে না বলে মত দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে, অনেক রাজনীতিবিদ বিভিন্ন পুরনো বা অসংলগ্ন ছবি বা ভিডিও নিয়ে মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোর চেষ্টা চালায়। এই আন্দোলনকে খালিস্তান আন্দোলনের অংশ, বা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে তারা চিহ্নিত করতে চাইলে কৃষকরা তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়। ডিসেম্বরে কৃষকরা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ বন্ধের উদ্দেশ্যে আলাদা ইউনিট গড়ে তুলে। অপরদিকে অনেক সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের সময় সরকারের কাছ থেকে হয়রানির অভিযোগ জানান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভারত সরকারের কাছে আন্দোলনের সংবাদ প্রদানকারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ব্যক্তিবর্গরা কৃষক আন্দোলন ও মোদী সরকারের অবস্থান নিয়ে মত দেয়। তবে পপ তারকা রিহানা ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের টুইটের পর সোশ্যাল মিডিয়াতে এই নিয়ে তীব্র আলোচনা হয়, যার বিরুদ্ধে টুইট করেন লতা মঙ্গেশকর, অক্ষয় কুমার, বিরাট কোহলি, শচীন টেন্ডুলকারসহ একাধিক ভারতীয় তারকা। তবে আন্দোলনকারীদের মতামত, এই টুইটগুলো ভারত সরকারের কাছ থেকেই আদেশপ্রাপ্ত হয়ে করেছেন তারকারা। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২০ এ ভারতের অবস্থান ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪তম; করোনা মহামারী শুরুর আগেই দেশটির বেকারত্বের হার বিগত ৪৫ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ। ক্ষমতাসীন ডানপন্থী সরকার দেশের অর্থনীতিকে আরো লিবারেল, সম্পদ বৃদ্ধির জন্য আরো সহায়ক করতে চাইলেও দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের জন্য এই লাগামহীন বাজার ব্যবস্থা দেশটিকে আরো সংকটের দিকে ঠেলে দিবে। কৃষক ন্যূনতম ন্যায্য মূল্যের গ্যারান্টি হারাবে; উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য রপ্তানিতে আরো চাপ পড়ায় কৃষিজীবী প্রডিউসার এবং কনজিউমার – উভয় গোষ্ঠী দারিদ্র্য ও খাদ্য সংকটে নিমজ্জিত হবে। ভারতের আন্দোলনকারী কৃষকেরা তাই দাবি করছেন যে সাম্প্রতিক তিনটি কৃষি আইন কোনোটিই সাধারণ কৃষক বা ভোক্তার নিরাপত্তার জন্য প্রণয়ন করা হয়নি, বরং ক্ষমতাশালী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মনোপলিতে দেশের কৃষি ব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। Authors
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |