সাদিক মাহবুব ইসলাম গত ১১ জুন উপস্থাপন করা হল ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট। প্রতিবছরই বাজেট উপস্থাপনের সময় টানটান উত্তেজনা থাকে আমাদের মাঝে। কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে, কোন কোন জিনিসের দাম কমবে তা দেখার জন্য আমরা বকের মত গলা বাড়িয়ে অপেক্ষা করি। যেসবের দাম বাড়ার কথা, চট করে সেগুলোর দাম বাড়ে বটে, কিন্তু যেসবের দাম কমার কথা,সেগুলোর দাম কমে শম্বুক গতিতে। তবে এবছরের বাজেটটা একটু আলাদা। কারণ দেশ এখন কোভিড-১৯ মহামারিতে বিপর্যস্ত। সবাই আশা করছিল, কোভিড-১৯ এ জর্জরিত অর্থনীতির জন্য বিশেষ বাজেট আসবে। দুঃখের বিষয়, এ বছরের বাজেটটা অন্যা্ন্য বাজেটের মতই গতানুগতিক। এখন আমরা এক নজরে বাজেটের কিছু দিক বিশ্লেষণ করে দেখব। বাজেটের আকার মোট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের জিডিপি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। বাজেটে বরাদ্দের দিক থেকে সেরা তিনে আছে জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা আর শিক্ষা। বাজেট নিয়ে অনেক কথাই হয়। আসুন আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। বিরাট আলোচনা, তাই আমরা স্বাস্থ্যখাত, শিক্ষাখাত, প্রবৃদ্ধি, কালো টাকা সাদাকরণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, বেকারত্ব আর মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। স্বাস্থ্যখাতঃ প্রথমেই আসতে হবে স্বাস্থ্যখাতে। স্বাস্থ্যখাত যে কতটা ভঙ্গুর তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই কোভিড-১৯ মহামারি। অপ্রতুল চিকিৎসা সমঞ্জামাদি আর অবকাঠামোগত দুর্বলতা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, বহুদিনের অবহেলা আর অনিয়ম এখন শোধ নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত ছিল স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া- কিন্তু অন্যান্য বারের চাইতে বেশি পার্সেন্টেজ দেয়া সম্ভব হয়নি। বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকায় তা দেওয়া হয়নি। তবে স্বাস্থ্য খাতে চলতি বছরের তুলনায় পাঁচ হাজার ৭৭৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২৫ হাজার ৭২৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। শীর্ষ বরাদ্দের পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। স্বাস্থ্যখাতের সংস্কারের কথা বারবার বলা হয়েছে বাজেটে। তবে এক্ষেত্রে কী করা হবে এবং কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু নেই বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেছেন, দেশে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই যে ভেঙে পড়েছে, এছাড়া অন্যান্য যে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো যাতে না হয় তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যে নেয়া হয় না, সেসব ব্যাপারে তেমন কোন পরিকল্পনা সেভাবে নেই। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, "ধরুণ নিরাপদ খাবার পানি যদি নিশ্চিত করা হয়, তাহলে ডাইরিয়া কম হবে। বায়ুদূষণ রোধ করলে এর প্রভাবে যে স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়, সেটা মোকাবেলা করা যাবে। অসুখ না হওয়া মানে হাসপাতালে যেতে হবে না। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে দেখা হয় না।" স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ অব্যবহৃত থেকে যায়। এটা হতাশাজনক। আর এর কারণ আমরা শুনে নিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানার কাছ থেকে, ''সময় মতো বরাদ্দ পাওয়া যায় না। বাজেট দেয়া হয় জুন মাসে। সেটা ছাড় করতে দুই-তিন মাস চলে যায়। ''যখন টাকাটা পাওয়া যায়, তখন সময় মতো টাকা খরচ করার সময় থাকে না। খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যায়। যার কারণে কাজ যে মানের হওয়া দরকার, তেমন কাজ আমরা করতে পারি না।" তিনি আরও বলেছেন, "প্রয়োজন কোথায়, কোন ক্ষেত্রে কতটুকু দরকার সেটা যাচাই করে বরাদ্দ হয় না। এটা একটা সমস্যা। বাজেট যখন করা হয়, পূর্ববর্তী বছরের যে টাকাটা থাকে, সেখান থেকে কিছু পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়।" স্বাস্থ্যখাত এবার বাজেটের ৭.২% পাচ্ছে। গবেষণার জন্য বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা। সামনের দিনগুলোতে কোভিড-১৯ এর টিকা আবিষ্কৃত হলে তা জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করার জন্য কোনো বরাদ্দ সরিয়ে রাখা হয়নি। আর চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা। শিক্ষাখাতঃ বাজেটে শিক্ষা খাত পাচ্ছে জিডিপির ২.০৯%। বলা বাহুল্য, এটা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। শিক্ষাবিদদের মতে, এ বছর অন্তত ১৫% বাজেট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিল শিক্ষাখাতে। তেসরা জুন ১২৬টি এনজিও এর মাঝে একটি জরিপ চালানো হয়। সেই জরিপ থেকে বেরিয়ে আসে- ৮৪% জরিপকারী বলছে ঝরে পড়ার হার বাড়বে; ৭২% বলছে অপুষ্টি শিক্ষাকে বিঘ্নিত করবে, ৫৮% বলছে বাল্যবিবাহ বাড়বে আর ৭১% বলছে শিশুশ্রম বেড়ে যাবে। ৮০% শিক্ষার্থীর পরিবারের আয় কমে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ৪০% শিক্ষার্থীর পরিবার চলে যাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে। এদের জন্য আলাদা প্রণোদনা অত্যন্ত দরকারি ছিল। এছাড়া কলরেট আর ইন্টারনেটের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি অনলাইন ক্লাস করায় বাধার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশে মোবাইলে কথা বলার ওপর শুল্ক ৩৩%- ভারতে ১৫% আর পাকিস্তানে ১৭%। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মাহতাব উদ্দীনের মতে, এই শুল্ক ডিজিটাল বাংলাদেশের গলা চেপে ধরেছে। প্রবৃদ্ধিঃ এবার বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮.০২%। বিশ্বব্যাংক বলছে, আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি মাইনাস হতে পারে। চীনের প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ এবং ভারতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক, মাইনাস ৩ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি এরকম বিরাট অঙ্ক আমাদের কী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে? এটা সরকারের মধ্যে একটা গা ছাড়া ভাব এনে দেবে। এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করতে হবে। এছাড়া আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যকে চাঙ্গা হতে হবে আর বৈশ্বিক মন্দাকে আগামী দুই-তিন মাসের মাঝে দূরীভূত হতে হবে। এসব লক্ষ্য অর্জন বেশ দুঃসাধ্যই বটে। কালো টাকা সাদাকরণঃ কালো টাকা সাদা করার জন্য এবছরও বেশ সুযোগ দেয়া হয়েছে। স্পেশাল ইকোনোমিক জোন বা হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগ করলে কালো টাকার উৎস পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হবে না। এখানে তিনটি সমস্যা আছে। প্রথমত, অর্থপাচারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৯ তম। আর এদিকে শীর্ষে আছেন গার্মেন্টস মালিকেরা, যারা এবছরও ১% অতিরিক্ত ক্যাশ-ইন্সেন্টিভ পাচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশের এই বিরাট অঙ্কের অর্থপাচারকারীরা কেন টাকা সাদা করতে আগ্রহী হবেন,এট একটা বিষয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সংবিধান ও সকল আইনবরোধী এই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। তৃতীয়ত, এইসকল স্পেশাল ইকোনোমিক জোন বা হাই-টেক পার্কের পারফরমেন্স নিয়ে সরকার ও অর্থনীতিবিদেরা অন্ধকারে। এ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে পাচার হয়েছে ৮ হাজার ৯৭৫ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে তা ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এই ধারা বন্ধ করতে না পারলে এমন লোভনীয় সুযোগ কোনো কাজেই আসবে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতঃ বাংলাদেশের অর্থনীতির ৯০%-ই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বা ইনফর্মাল ইকোনমি। শুধু ঢাকা শহরেই হকার ও ফেরিওয়ালার সংখ্যা তিন লাখের বেশি। দর্জির সংখ্যা কয়েক লাখ। রিকশাচালকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে লবণশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। কুয়াকাটা ও কক্সবাজার মিলিয়ে এক লাখের বেশি জেলে ও শ্রমিক জড়িয়ে আছেন শুঁটকিশিল্পের সঙ্গে। সারা দেশে পরিবহনশ্রমিকের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মতে, তাঁদের মধ্যে ৪৪ লাখ পরিবহনকর্মীই অবৈধ। ঠিকে বুয়া বা ঝি আছে ৫ লাখ। আছে স্থানীয় শিল্প। পোল্ট্রি শিল্পে আছে ৫০ লাখ মানুষ। এদের কথা থাকা উচিত ছিল বাজেটে। বেকারত্বঃ সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং এর এক গবেষণায় এসেছে, কোভিড-১৯ এর ফলে বেকারত্ব বেড়ে ৪০.৯% হতে পারে। মানে আরো ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে যেতে পারে। সরকার কেবল গার্মেন্টসকর্মীদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।কিন্তু যারা নতুন করে কাজ হারাতে পারে- যার সংখ্যা কম করে হলেও ৫০ লাখ, তাদের জন্য বেকারভাতা বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধে রাখা হয়নি বাজেটে। রাখা হয়নি গণহারে কর্মচারী ছাঁটাই রোধ করার জন্য কোনো ব্যবস্থা। গত অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল যুবকদের স্টার্ট-আপ বিজনেসে প্রণোদনার জন্য এবছর তা আর নেই। মেগাপ্রজেক্টঃ সাতটি মেগাপ্রজেক্টের জন্য এবছরের বাজেটে ৩৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এর মাঝে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য- ১৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিদ্যুতখাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরপরও এই বিরাট বাজেট রূপপুরের জন্য রাখাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা প্রশ্নের দাবি রাখে। এছাড়াও মেট্রোরেল-৬ এর জন্য ৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে- এটিও কতটা জনগুরুত্বপূর্ণ তা প্রশ্নের বিষয়। বাংলাদেশের এখন উচিত, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন আরো তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়া। এছাড়াও এসডিজি অর্জন লক্ষ্যমাত্রাও তিন বছর পিছিয়ে দেয়া উচিত। কারণ এ মূহুর্তে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে ওঠার প্রচেষ্টা আমাদের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। পরিশেষে একটি কথাই বলা যায়, কোভিড-১৯ দ্বারা পর্যুদস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এ বাজেটটি যথাযথ নয় একেবারেই। এখন সামনে কী আছে, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। সাদিক মাহবুব ইসলাম সাদিক মাহবুব ইসলাম অর্থনীতি নিয়ে বইয়ের বাইরে চিন্তা করতে পছন্দ করে। তার প্রিয় বিষয় সমাজ,রাজনীতি,সাহিত্য ও ইতিহাস। আধ-একটু কাব্যচর্চা আর গল্প লিখতে ভালোবাসে সে, ভালোবাসে অবসরে গান শুনতে আর বই পড়তে। মানবিক,সাম্যবাদী ও কল্যাণমুখী সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখে সে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |