শারদ নওশাদ আবদুল্লাহ, মোঃ তাকরিম হোসেন, মো. রাকিবুল মবিন, ফারহা তাসনীম, শাহরান হুসাইন অলিম্পিক গেমস বিশ্বের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম ক্রীড়া আসর। ইভেন্টগুলো যতটা উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার উদযাপন, তেমনি সেগুলো মানবতা এবং ক্রীড়া শ্রেষ্ঠত্বেরও উদযাপন। আর একটি বড় ক্রীড়া ইভেন্টের আয়োজন করা আয়োজক দেশের জন্য অর্থনৈতিক এবং সামাজিক, উভয় সুবিধা বয়ে আনে। অলিম্পিক গেমস আয়োজন করাকে সর্বদাই একটি জাতীয় গর্বের বিষয় বলা হয়ে থাকে। তবে ১৯৬০-এর রোম অলিম্পিক গেমস থেকে শুরু করে চলমান টোকিও অলিম্পিক গেমস পর্যন্ত কিছু উদাহরণ বাদে প্রতিটি অলিম্পিকই দেখেছে আর্থিক ক্ষতির মুখ। তারই প্রতিলফন দেখা যাচ্ছে দিনে দিনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকা আগ্রহী আয়োজক শহরের তালিকার দিকে তাকালে। যেখানে ২০০৪ সালের গেমসে, যা এথেন্সে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, আয়োজনের জন্যে প্রার্থী শহর ছিলো মোট ১১ টি, সেখানে ২০২৪ সালের আসরের জন্য প্রার্থী শহরের সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। এছাড়াও ২০১৬ রিও অলিম্পিক এবং ২০২০ টোকিও অলিম্পিক আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে আয়োজক দেশের জনগণের পক্ষ থেকে। জাতীয় গর্ব এবং ভূ -রাজনৈতিক অঙ্গনে আয়োজক দেশ ও শহরের মর্যাদা বৃদ্ধির একটি বিষয় থাকলেও অলিম্পিক আয়োজনের পেছনে একটি শহরের মূল উদ্দেশ্য সর্বদাই অর্থনৈতিক লাভ। অলিম্পিক আয়োজনের ফলে মিডিয়ার উপস্থিতি বৃদ্ধি হয়ে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা হতে পারে পর্যটন, শহুরে পুনঃজাগরণ এবং আয়োজক দেশের জন্য মানব সম্পদ গঠনের ক্ষেত্রে। অলিম্পিক বাজেটের বরাদ্দ এবং ব্যবহার অলিম্পিক আয়োজনের জন্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিতে (আইওসি) কেবল দরপত্র জমা দিতেই কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। শহরগুলো সাধারণত পরামর্শদাতা, ইভেন্ট আয়োজক এবং হোস্টিং কর্তব্য সম্পর্কিত ভ্রমণের জন্য ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ অলিম্পিকের জন্য টোকিও তার দরপত্রে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার হারায় এবং ২০২০ সালের সফল আবেদনের জন্য প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ক্রীড়া ইভেন্টগুলো আয়োজন করা বিডিং প্রক্রিয়ার চেয়েও অনেক বেশি ব্যয়বহুল। উদাহরণস্বরূপ, লন্ডন ২০১২ সালে অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিক আয়োজনের জন্য ১৪.৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। যার মধ্যে ৪.৪ বিলিয়ন ডলার এসেছিল দেশের করদাতাদের কাছ থেকে। ২০০৮ সালে বেইজিং ৪২ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। এথেন্স ২০০৪ সালের অলিম্পিক আয়োজনের জন্য ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। আর সেই অর্থের জন্য যে ঋণের সৃষ্টি হয় তা সম্পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত এথেন্সের করদাতাদের বার্ষিক হারে প্রায় ৫৬,৬৩৫ ডলার করে পরিশোধ করতে হয়। ২০০০ সালের অলিম্পিকের আয়োজনের জন্য সিডনি ব্যয় করে ৪.৬ বিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে ১১.৪% আসে করদাতাদের কাছ থেকে। একটি শহর অলিম্পিক আয়োজনের জন্য নির্বাচিত হবার পর সাধারণত রাস্তা, বিমানবন্দর, রেললাইনসহ অবকাঠামো বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। এছাড়াও ক্রীড়াবিদদের আবাসন, হোটেল কক্ষসহ ইভেন্টগুলোর জন্য বিভিন্ন সুবিধা তৈরিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। সামগ্রিকভাবে, অবকাঠামোগত খরচ হয়ে থাকে প্রায় ৫ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। ২০১২ সালের লন্ডন, ১৯৮৪ সালের লস এঞ্জেলেস এবং ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা গেমস ছাড়া বিগত ৬০ বছরের প্রায় প্রতিটি অলিম্পিক গেমসই অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। অলিম্পিকের অর্থনৈতিক প্রভাব অলিম্পিক আয়োজনে অত্যন্ত ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়, যার ইভেন্ট পরবর্তী ব্যবহার নেই বললেই চলে। কিন্তু ব্যবহার না থাকলেও এসকল অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। যেমন: সিডনি অলিম্পিক স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণে বার্ষিক ৩০ মিলিয়ন ডলার এবং বেইজিংয়ের বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণে বার্ষিক ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এছাড়া নন-স্পোর্টিং অবকাঠামো তো আছেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আয়োজক শহরগুলোর কয়েক দশক ধরে ঋণের ভার বহন করতে হয়। দায় মেটাতে নাগরিকদের উপর আরোপ করা হয় বিভিন্ন কর। ১৯৭৬ সালে মন্ট্রিল অলিম্পিক আয়োজনের পর শহরটি যে পরিমাণ দায়গ্রস্ত হয়েছিল, তা পরিশোধ করতে সময় লেগেছিল ৩০ বছর। অলিম্পিক আয়োজনের ঘাটতি পূরণ করতে কানাডায় ফেডেরাল গভর্নমেন্ট কর্তৃক আয়োজিত লটারি পরবর্তীতে বহাল রাখা হয়, যা মূলত শুরুও হয়েছিল মন্ট্রিল অলিম্পিকের তহবিল সংগ্রহের জন্য। অনেকের মতে ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত সিডনি অলিম্পিক আয়োজকদের দূরদর্শিতার পরিচায়ক হলেও এই সংস্করণেও ছিল অর্থনৈতিক হ্রাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিডনি অলিম্পিকের কারণে ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারের এবং জনগণের সামগ্রিক ব্যয় কমেছিলো ২.১ বিলিয়ন ডলার। সিডনির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২০০০ সালের পর থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত কমেছে, যাতে সিডনি অলিম্পিকের ‘অবদান’ রয়েছে। গত দশকে গ্রীসে চলমান ভয়াবহ ঋণ সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে ২০০৪ সালে গ্রীসের এথেন্স অলিম্পিকের আয়োজনকে দায়ী করেন। আয়োজকদের দূরদর্শিতার অভাবের কারণে নির্মাণকৃত অনেক স্থাপনা পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত হয়। অলিম্পিক আয়োজনে গ্রীসের খরচ হয়েছিল প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল প্রাথমিক বাজেটের দ্বিগুণ। এরপর থেকে গ্রীসের ক্রমবর্ধমান ঋণ একপর্যায়ে গিয়ে ৩৮২ বিলিয়ন ডলারে ঠেকে। যা থেকে পরিত্রাণের জন্যে পরবর্তীতে প্রয়োজন হয় একাধিক বেইল-আউটের। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকের আয়োজক দেশ ব্রাজিলে সেই সময় ইতোমধ্যেই ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে বড় মন্দা চলছিল। এর মধ্যে তাদের অলিম্পিক আয়োজনের খরচ বাজেটের তুলনায় বাড়ে ৩৬৮ শতাংশ। আয়োজন খরচ মেটাতে রিও কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। অলিম্পিক পরবর্তী সময়ে ব্রাজিলের জিডিপি ৩.৩% হ্রাস পায়। কর্মসংস্থান এবং অলিম্পিক অলিম্পিক আয়োজনে আয়োজক শহরের নাগরিকদেরও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চাকরি হারাতে হয় অনেক নাগরিকের। এছাড়া অলিম্পিক আয়োজন যেই পরিমাণ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে ভেবে আয়োজক দেশ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়, সেই লক্ষ্যও পূরণ হয় না। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত লন্ডন অলিম্পিকে স্থানীয়দের জন্য ২০,০০০ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর অর্ধেকেরও কম (৯৭০০) কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এছাড়া অলিম্পিক ভিলেজ এবং এর আশেপাশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনির্মাণে বাস্তুচ্যুত করা হয় অগণিত মানুষকে। ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিক আয়োজনের জন্য ৪৮,০০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং ৭২০,০০০ নাগরিককে উচ্ছেদ করা হয়। ২০০৮ সালের বেইজিংকে ঘিরে একটি প্রধান সমস্যা ছিল নতুন অবকাঠামো এবং উচ্চ আয়ের আবাসন নির্মাণের জন্য ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ব্যাপকভাবে জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনা। জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনা চীনে আগে ঘটে থাকলেও বেইজিং অলিম্পিকের আগে আগে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী বিতাড়িত জনসংখ্যার আকারকে প্রায় ১৫ লাখ বলে অনুমান করা হয় এবং সরকারের প্রদানকৃত ক্ষতিপূরণ ছিল নগণ্য। রিও অলিম্পিকের জন্য অবকাঠামো নির্মাণেও উচ্ছেদ করা হয়েছে অসংখ্য ফ্লাভেলা, যাতে মূলত বসবাস ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। উচ্ছেদ কাজে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৬০,০০০ থেকে ৭০,০০০ মানুষ। এভাবে আয়োজক শহরের নাগরিকদের জন্য বরাবরই দুঃস্বপ্ন নিয়ে এসেছে ‘দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। আয়োজক শহরের অর্থনীতিতে অলিম্পিকের প্রভাব অলিম্পিকের মতো বড় ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজন একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি, যা আয়োজক শহরের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু এটি বরাবরই একটি বৃহৎ চ্যালেঞ্জ, এবং "অলিম্পিক অভিশাপ"-এ আক্রান্ত শহরগুলোর ক্ষেত্রে যেমন প্রমাণিত, আয়োজনটির দীর্ঘমেয়াদী অনেক প্রভাব রয়েছে। দুটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো- বেইজিং ২০০৮ গেমস এবং বার্সেলোনা ১৯৯২ গেমস। বেইজিং ২০০৮ এখন পর্যন্ত সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অলিম্পিক, যার আনুমানিক বিল প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। যদিও অলিম্পিকের জন্য নির্মিত কিছু অবকাঠামো দীর্ঘমেয়াদে উপকারী প্রমাণিত হয়েছে যেমন উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং অন্যান্য সবুজ উদ্যোগ; এগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার কর্মসূচি এবং সমাজকল্যাণমূলক উদ্যোগের মতো জরুরি খাতে ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে সাধিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এসব খাতে চীনের অবস্থান ব্যয় হ্রাসের আগেও বেশ দুর্বল ছিল। ৫০০ মিলিয়ন ডলারের "বার্ডস নেস্ট" এবং ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের টার্মিনালের মতো বিশাল প্রকল্প অলিম্পিকের পর থেকে প্রায় অব্যবহৃত রয়েছে। এসব ব্যায়বহুল প্রকল্প চীন সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের বোঝা। উপরন্তু, চীনের কঠোর ভিসা নীতির কারণে বেইজিংয়ের পর্যটন সম্ভাবনা এমনিতেই দুর্বল ছিল। যার ফলে বাড়তি পর্যটনের প্রত্যাশায় নির্মিত হোটেল এবং অন্যান্য পরিষেবা পরিকাঠামোও ছিল অব্যবহৃত। এদিকে, বার্সেলোনা ১৯৯২-এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্পেনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে বার্সেলোনা ছিল শিল্পখাতে অনুন্নত একটি শহর। মোট খরচ প্রায় ৯.৩ বিলিয়ন ডলার আসার পরেও ১৯৯২ সালে গেমস আয়োজনের কারণে শহরটি অত্যন্ত উপকৃত হয়েছিল। এর মূলে ছিল বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামোগত উন্নয়ন। রাস্তা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, সবুজ এলাকা এবং সমুদ্র সৈকত ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিল; সমুদ্রসংলগ্ন কলকারখানা উচ্ছেদ করে প্রায় ২ মাইল নতুন সমুদ্র সৈকত এবং মেরিনা তৈরি করা হয়েছিল। এরূপ ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে শহরটির অত্যন্ত দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়। জনসংখ্যার বেকারত্ব নিরসনেও এটি স্পষ্ট প্রভাব রেখেছিল। কারণ ১৯৮৬ সালে বার্সেলোনা শহরে বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার, যা ১৯৯২ সাল নাগাদ তার অর্ধেকে নেমে এসেছিল। বার্সেলোনা অলিম্পিক আয়োজনের অন্যান্য কিছু অপ্রত্যাশিত সুবিধাও লাভ করে। অলিম্পিককে কেন্দ্র করে ক্রীড়া অবকাঠামোতে বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগকে খেলাধুলায় স্পেনের বর্তমান আধিপত্যের কারণ বিবেচনা করা হয়। স্পেন ফুটবল, সাইক্লিং, বাস্কেটবল এবং টেনিসের মতো প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায় বিশ্বমানের প্রতিভা তৈরি করে। স্পেনের লা লিগা ফুটবল লীগ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সম্প্রচারিত ক্রীড়া লীগগুলোর একটি, এবং টেনিস তারকা রাফায়েল নাদালের মতো ক্রীড়াবিদদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। এই দুটি ঘটনা অলিম্পিক আয়োজক শহরের নানামুখী সুদূরপ্রসারী পরিণতির আভাস দেয়, যা অলিম্পিকের অর্থনৈতিক গুরুত্বকে আরও দৃঢ় করে। অলিম্পিকের মর্মঃ প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা অলিম্পিক এমন একটি ক্রীড়া ঐতিহ্য যার ইতিহাস তাকে এক বিরল সার্বজনীনত্ব দান করে। ভূ -রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়াতে, নাগরিক গৌরব এবং গণমাধ্যমে দৃশ্যমানতা বৃদ্ধিতে অলিম্পিকের প্রভাব গুরুতর বিবেচ্য বিষয় আয়োজক শহরগুলোর জন্য। তবে এই সুবিধাগুলি বিনামূল্যে লাভ করা যায় না। সাম্প্রতিক আলোচনায় অলিম্পিকের এই মডেলের স্থায়িত্ব এবং দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ, এবং একটি ব্যবসাকেন্দ্রিক বিনোদন শিল্পের ত্রুটি সত্ত্বেও অলিম্পিক সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বকে অনুপ্রাণিত করতে পারে কিনা- সেই প্রশ্নও মানুষের মনে রয়েছে। অলিম্পিক ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাকে বরাবরই অতি কঠোর বলে আখ্যায়িত এবং "কারখানার তৈরি" পদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অত্যধিক চাপের কারণে ক্রীড়াবিদদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে আতংকজনক হারে বাড়ছে। এরকম ঘটনা ক্রীড়া বিনোদনকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশার প্রকৃত মূল্য বেদনাদায়ক ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্বখ্যাত সাতারু মাইকেল ফেল্পস এবং টেনিস তারকা নাওমি ওসাকার মতো জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদেরা তাদের বিষণ্ণতা এবং হীনমন্যতা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করেছেন। মানসিক অবসাদের সঙ্গে এই নিরন্তর সংগ্রামের কারণ হিসেবে তারা তাদের প্রতি পাহাড়সম প্রত্যাশার চাপ এবং কঠোর পেশাদারি জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আরও গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস। নিজ ক্রীড়া দলের চিকিৎসকের হাতে তিনি এবং তারা সহকর্মী নারী ক্রীড়াবিদেরা যৌন হয়রানির শিকার হন। এরূপ বীভৎস অভিযোগ এমন এক ব্যবস্থা ও কর্মপরিবেশের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে নারী ক্রীড়াবিদেরা নিরাপদ নন। নারী ক্রীড়াবিদদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের আরও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে বৈশ্বিক ক্রীড়া শিল্পজুড়ে, যা আমাদের ক্রীড়াবিদদের নিরাপত্তার প্রতি উদাসীনতাই প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক খেলাধুলার মতো গণবিনোদন শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে আয়োজনটিতে বৈশ্বিক ঐক্য এবং "অলিম্পিক স্পিরিট"-এর ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গুরুতর বাণিজ্যিক এবং ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের উপস্থিতিতে অলিম্পিকের মতো বৈশ্বিক আসরের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা দুরূহ। বিদ্যমান শত্রুতার প্রকাশ থেকে অলিম্পিকও নিরাপদ নয়। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা আফগানিস্তান আক্রমণের প্রতিবাদে ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক ন্যাটো জোটের রাষ্ট্রগুলো বর্জন করে, যার ফলে ১৯৮৪ লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক সোভিয়েত ব্লকের রাষ্ট্রগুলি দ্বারা বর্জিত হয়। জলবায়ু এবং প্রকৃতির উপর প্রভাব যখন পুরো পৃথিবীর চোখ এক জায়গায় থাকে - জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, পানি দূষণের মতো হুমকিগুলো আরও বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অলিম্পিক গেমসের একটি নিখুঁত উদাহরণ।
- বিভিন্ন অলিম্পিক সু্যোগ-সুবিধা এবং আবাসনের জন্য জায়গা তৈরি করতে, সোচি জাতীয় উদ্যানের ৮০০০ একরেরও বেশি জায়গা খালি করা হয়েছিল ফলে দুর্লভ জলাভূমি ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে। সেখানে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, ভাল্লুক এবং সরীসৃপ নতুন আস্তানার সন্ধানে চলে যায়। রাশিয়ার রাজনীতিবিদেরা জাতীয় উদ্যানগুলো রক্ষা করার আইনগুলো পাল্টে দিয়েছিলেন যাতে এই নির্মাণ সম্ভব হয়।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি(আইওসি): রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) বিবৃতি অনুসারে, এটি তার আয়ের ১০ শতাংশ নিজেদের পরিচালনায় ব্যয় করে এবং বাকি ৯০ শতাংশ পুনর্বণ্টন করে। সাম্প্রতিক সময়ে আইওসির কেন্দ্রীয় খরচ বেড়ে চলেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে- এই চার বছরে আইওসি ৫.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে কিছুটা কম আয় করেছে। প্রকৃতপক্ষে, আর্থিক এবং সহযোগীদের ক্ষতির হিসাব নেওয়ার পর মাত্র ৫.৬ বিলিয়ন ডলার বাকি থাকে। আইওসি পরিচালনা করার ব্যয়/কেন্দ্রীয় পরিচালন এবং প্রশাসনিক খরচে এই চার বছরের সমষ্টি হচ্ছে ৬৭০ মিলিয়ন ডলার অথচ ৫.৬ বিলিয়নের ১০ শতাংশ ৫৬০ মিলিয়ন। আইওসি কি তার নিজস্ব কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত না করে, তার রাজস্বের ৯০ শতাংশ পুনর্বণ্টন করে দেয়? এদিকে, ২০১৫ সালে, একটি নতুন খরচখাত, "অলিম্পিক আন্দোলনের প্রচার" চালু করা হয়েছিল। এটি দুটি খরচ কেন্দ্র নিয়ে গঠিত: অলিম্পিক চ্যানেল এবং "সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য"। তত্ত্বানুসন্ধানে দেখা গেছে, “সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য” খাতে খরচ বছরে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার, যার বেশিরভাগই আগে কেন্দ্রীয় পরিচালন এবং প্রশাসনিক খরচগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হত। আর প্রকৃতপক্ষে, ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় পরিচালন ও প্রশাসনিক খরচের ১৯০.১ মিলিয়ন ডলার, ২০১৫ সালের হিসাবে, ১৪০.৭ মিলিয়ন হিসেবে পুনর্বহাল করে হয়েছে। এছাড়া, “অলিম্পিক গেমস-সংক্রান্ত” ব্যয়ের ৭৮৯.৫ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫৪.৫ মিলিয়ন ডলার "আইওসি অপারেশনস"-এর জন্য বরাদ্দ। ২১.৫ মিলিয়ন ডলার বিভিন্ন বিডের খরচ, হোস্ট-সিটি সম্পর্কিত আইওসি কমিশন, "বিশেষ প্রকল্প"-এর ৪৬ মিলিয়ন ডলার এবং "অনুদান এবং অবদান"-এর ২৪.৫ মিলিয়ন ডলার, যার আর কোন ব্যাখ্যা করা হয়নি। রাজস্বের এ ব্যয় নিঃসন্দেহে সার্থক ছিল, কিন্তু এই অর্থ গেল কোথায়? অতীত ও ভবিষ্যৎ প্রাচীন গ্রীসে তার শুরু থেকে বর্তমান সময়ের মধ্যে অলিম্পিক হয়ে উঠেছে পৃথিবীর প্রধান ক্রীড়া অনুষ্ঠান। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন জাতির মাঝে একতা, প্রতিযোগিতা এবং খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব বিকাশের লক্ষ্যে স্থাপিত, অলিম্পিক বৈশ্বিক ঐক্যের একটি স্থায়ী প্রতীক। কিন্তু এই আকারের একটি আয়োজনের গুরুভার বহন করার ব্যবহারিকতা এবং আধুনিক বিশ্বের পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অলিম্পিকের প্রয়োজনীয়তা এবং নীতিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আধুনিক প্রত্যাশা এবং বাস্তবতা পূরণের লক্ষ্যে অলিম্পিকের বিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। অতএব এই ক্রীড়া ঐতিহ্যের ভবিষ্যৎ আকার অনিশ্চিত এবং এটি বিকশিত হওয়ার চ্যালেঞ্জ বহুমুখী। তথ্যসূত্র
Sharod Nowshad Abdullah On a journey to understand the world and my place in it, I like taking it one day at a time. Student of economics. Reader of books. Player of video games. Md. Takrim Hossain An undergraduate student majoring in Economics. A lifelong Liverpool fan and an avid reader, he loves to talk about Geopolitics, Political economy, Military history and Norse Mythology. Send him freshly baked Asterix fanfiction ideas at [email protected] Md. Rakibul Mobin University 'freshman' who would be very successful if procrastination were a job. Interested in a lot of unimportant things that attracts simply no one. Farha Tasneem A perpetual learner trying to understand how the world works so that she can face it head-on. And to help her with this cause she is currently studying Economics at the University of Dhaka. She has a knack for Indian classical music and spends her free time either reading or watching movies & tv-series. Shahran Hussain Undergrad student majoring in Economics; interested in Geopolitics, Policy and Development. Avid fan of classical arts and psychology.
1 Comment
Sajal Kundu
8/15/2021 10:00:51 am
খুব চমৎকার লেখা
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |