সাদিক মাহবুব ইসলাম সম্প্রতি সংসদে পাস হলো ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। দেশের ৫০তম বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এ বছরের বাজেটে শিক্ষাখাতের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলছিলেন বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং এই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আমাদের নীতিনির্ধারকরা শিক্ষাখাতে বাজেটের কমপক্ষে ২০% বরাদ্দ রাখবেন – এই প্রত্যাশা ছিল সকলের। বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২১ শতাংশের মতো বেশি। গত অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও পরে তা ৭৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা খাতে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ছিল ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা এবং আইসিটি খাতে ১৭২০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫.৭%, যা বিগত বাজেটে ছিল ১৫.১%। বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে একত্রে রাখার উদ্দেশ্য একটাই – বাজেটকে বড় দেখানো। শুধু শিক্ষাখাতকে হিসেব করলে দেখা যাবে যে, শিক্ষার জন্য বরাদ্দ মাত্র ১০%। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে একটি দেশের বাজেটের ২০%, তথা জিডিপির ৬% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখতে হয়। বাংলাদেশে রাখা হয়েছে তার অর্ধেকেরও কম – জিডিপির ২.০৮%। আন্তর্জাতিক মান পূরণ করতে না পারা এ শিক্ষাব্যবস্থার উপর যোগ হয়েছে কোভিড-১৯ মহামারির খাঁড়া। গত দেড়বছর ধরে একদম ঘরে বসে আছে দেশের শিক্ষার্থীরা। অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু ইন্টারনেট কানেকশন, নেটওয়ার্ক সঙ্কট এবং আর্থিক কারণে দেশের একটি বড় অংশই এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরকম অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আরো মনোযোগী হবে এমনটাই ভেবেছিলেন সবাই। শিক্ষাখাতে বরাদ্দের হিসেবে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নিচের দিক থেকে তৃতীয়। আগামী দশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে দ্রুত উন্নত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো বারবার শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হবে এমনটা বলার পরেও দেখা যায় যে, ২০০০ সাল থেকে বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশের আশপাশেই থাকছে। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি হিসেব করলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বাজেট সবচেয়ে কম। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে ওয়ার্ল্ড এজুকেশন ফোরাম এডুকেশন ২০৩০-এর এজেন্ডা ঘোষণা করে যেখানে সদস্য দেশগুলোকে বাজেটের ১৫-২০% বা জিডিপির ৪-৬% ব্যয় করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়াও এসডিজির চতুর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিক্ষার প্রতি বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ বাড়ানোই কি শেষ কথা? বরাদ্দ বাড়ালেই কি এসডিজি বা এডুকেশন ২০৩০-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব আমরা? বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়াও আমাদের আরো কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৬%। বছরে বছরে বরাদ্দ বেড়েছে, একইসাথে অনেক দূর অগ্রসরও হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এখন আমাদের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে বেশ কিছু বিষয়, যা আমাদের শিক্ষাখাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি করা। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের পেছনে বড় ইন্সেন্টিভ হিসেবে কাজ করেছে এমডিজি বাস্তবায়ন। আর এমডিজি কোয়ালিটির চাইতে কোয়ান্টিটিকে প্রাধান্য দেয়। এ কারণেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানোন্নয়ন এখনো সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। গ্লোবাল নলেজ ইন্ডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২ তম। বাংলাদেশের স্কোর ৩৫.৯, যা দক্ষিণ এশিয়াতে সর্বনিম্ন। ইন্ডেক্সটি করা হয় সাতটি সেক্টরের ১১৩টি ভ্যারিয়েবল হিসেব করে – pre-university education; technical and vocational education and training; higher education and research; development and innovation; information and communication technology; economics; and general supportive environment. এই স্কোরটিই বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান সম্পর্কে বেশ পরিষ্কার একটি ধারণা দেয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষক সংকট এবং শিক্ষাদানের মান। আদর্শ শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ছয়টি বিষয় ধর্তব্য – পাঠ্য বিষয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা, শিক্ষকের যোগ্যতা, পাঠদান পদ্ধতির যথাযথ ব্যবহার, ফলাফল, কার্যকর উপস্থাপনা এবং শিক্ষকের আত্ম-পর্যালোচনা। বাংলাদেশের শিক্ষকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ছয়টি ক্যাটাগরিতে পাস মার্ক তুলতে পারবেন না। এর পেছনে কয়েকটি কারণ দাঁড় করানো যায় – শিক্ষকেরা তাদের পেশার প্রতি যত্নশীল নন, তাদের বেতনভাতা অত্যন্ত কম, তাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নেই এবং ক্লাসরুমের বাইরে পড়ানোর প্রতি বেশি আগ্রহ থাকা। বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা তো আন্দোলন করেও তাদের চাকরি আর বেতনভাতা নিশ্চিত করতে পারেননি। এর বাইরে যারা আছেন, তাদের অবস্থা যে আহামরি ভালো, তা নয়। এর পাশাপাশি আছে দুর্নীতির উপদ্রব। সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ২০১২ সালে মোট ৭০.৩ কোটি টাকার ঘুষ আদান-প্রদান করা হয়েছিল বলে টিআইবি ২০১৩ সালে রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০২০ সালে এসে হয়ে এই পরিস্থিতি কোথায় এসে ঠেকেছে তার ডেটা না থাকতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি যে উধাও হয়ে যায়নি সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ওদিকে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, ভিয়েতনামের ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের গণিত ও বিজ্ঞানে দক্ষতা জার্মানির ১৫ বছর বয়সীদের সমতুল্য। বাংলাদেশের কথায় আর না যাই। প্রাইমারি স্কুলের জন্য শিক্ষাখাতের বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ ব্যয় করা হয় (৭২%)। অথচ এর পরেও তা দক্ষিণ এশিয়ার গড় বাজেটের চাইতে ৭২.১% কম, আর নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোর চাইতে ৭০.১% কম। একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীর পেছনে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার ছয়ভাগের এক ভাগ আর ভারতের তিনভাগের একভাগ ব্যয় করে। এর প্রত্যক্ষ ফল হলো প্রাইমারি স্কুলে ৯৮% শিক্ষার্থী ভর্তি হবার পরেও মাত্র ৫৭% শিক্ষার্থী দশ বছরে বয়সে এসে ঠিকমত পড়তে পারে। মাত্র ২৫% ক্লাস ফাইভের শিক্ষার্থী ন্যূনতম গাণিতিক দক্ষতা দেখাতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মোটামুটি চার ধরণের মাধ্যম চালু রয়েছে – বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন এবং মাদ্রাসা। এরকম হায়ারার্কিকাল বিভাজন এবং আর্থিক অসমতার কারণে গুটিকয়েক শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উপরিউক্ত স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে পারে। এবং এই বিভাজন একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে, যেখানে ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা দক্ষতা লাভ করে, আর সরকারি স্কুলের বাংলা মিডিয়াম আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা একেবারেই তলানিতে রয়ে যায়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এত বিরাট বাজেট যে রাখা হয়েছে প্রাইমারি শিক্ষার জন্য (বাজেটের সিংহভাগ), সেটা কই গেল? উত্তরটা হলো – এই বাজেটের ৯০% চলে যায় বেতন দিতে আর অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে। ২০১৫ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষক – শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০। বিজ্ঞান ও গণিতে এই হার আরো কম। এর ফলে বিজ্ঞান ও গণিতের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখনো পিছিয়ে। ইংরেজি পারদর্শিতা স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ৪৭৬, অবস্থান ৬৩ তম স্থানে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ পাবলিকেশনে গত কয়েক বছরে প্রকাশিত কাজের ৮৪% করেছে ভারত, ৬.৪% করেছে পাকিস্তান, আর ৩.২% বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে ২০২০ সালে ভারতীয় গবেষকরা প্রকাশ করেছেন ১৯৯,০০০টি পেপার, পাকিস্তানি গবেষকরা ২৮,০০০ পেপার এবং বাংলাদেশি গবেষকরা মাত্র ৮,০০০ টি পেপার। এ বছরের বাজেটে গবেষণার জন্য বরাদ্দ মাত্র ০.১৭%। ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৭৪ কোটি টাকা মাত্র বরাদ্দ। মানে ভাগে পড়তেছে মাত্র দুইকোটি টাকা। সেটা আবার সব ডিপার্টমেন্টে ভাগ হয়ে যাবে। ফলত, একেক বিভাগ পায় মাত্র দুই-তিন লাখ টাকা। এরকম হাস্যকর রকমের কম বাজেট গবেষণার জন্য যথেষ্ট নাকি সেটাই ভাবার বিষয়। আর এর ফল হলো রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে ফান্ডিংয়ে প্রথম ৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই, যেখানে ভারত সপ্তম এবং পাকিস্তান ৪২ তম অবস্থানে রয়েছে। আরেকটি বড়সড় সমস্যা হলো অ্যাসেসমেন্ট বা মূল্যায়ন। বাংলাদেশ এডুকেশন ফর অল (ইএফএ) ২০১৫ ন্যাশনাল রিভিউয়ে দেখা যায় যে, প্রাইমারি স্কুলের মাত্র ২৫% শিক্ষার্থী রিডিং আর রাইটিং টেস্ট সম্পূর্ণভাবে পাস করতে পেরেছে। তাছাড়া প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাডমিশন টেস্টের সময় শিক্ষার্থীদের গণহারে ফেল করার খবরও বেশ চিন্তাজনক। এখন এসকল সমস্যার সমাধান না করা হলে শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়ানো হলেও কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যাবে না। বাজেট কম, এবং সেটা কতটা কম বুঝতে হলে ছোট্ট একটা তুলনা করতে হবে। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বাজেট হলো মোট ১৫.৭%, আর প্রথম দশটা মেগাপ্রজেক্টের জন্য বরাদ্দ ১০%। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রেফারেন্স যে আসলে কী, সেটা এই ফিগার দেখলেই বোঝা যায়। এবং এত সমস্যার পর অচিরেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উন্নতি হবে, এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। তবে সামনের দিনগুলো পেছনের দিনগুলোর চাইতে ভালো হবে, এই আশাবাদটা তো রাখাই যায়, নাকি? সূত্রঃ সাদিক মাহবুব ইসলাম সাদিক মাহবুব ইসলাম অর্থনীতি নিয়ে বইয়ের বাইরে চিন্তা করতে পছন্দ করে। তার প্রিয় বিষয় সমাজ,রাজনীতি,সাহিত্য ও ইতিহাস। আধ-একটু কাব্যচর্চা আর গল্প লিখতে ভালোবাসে সে, ভালোবাসে অবসরে গান শুনতে আর বই পড়তে। মানবিক,সাম্যবাদী ও কল্যাণমুখী সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখে সে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |