মোঃ আহাদ আল আজাদ মুনেম নি:সন্দেহে আমরা স্মরণকালের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে এখন কোভিড-১৯ মহামারীর আতঙ্ক। এর মাঝে মানুষ আজ বেঁচে থাকবে কিনা সেটারই কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেখানে কয়েক মাস পরের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিছক বিলাসিতা মনে হতেই পারে। তবে আশাবাদী হতে কোনো বাধা নেই। পৃথিবী সব সময় দুর্যোগ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবারও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে এই আশাই করছি। আর সেই পৃথিবী যে অনেকটাই বদলে যাবে করোনা পূর্ব পৃথিবীর তুলনায়, সে ইঙ্গিত বিজ্ঞজনেরা বিভিন্ন সময়ে দিচ্ছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশে ঘোষিত লক ডাউনের ফলে অর্থনীতি বিরাট ধাক্কা খাচ্ছে। আইএমএফ-এর মতে, বিশ্ব ইতোমধ্যে মন্দার সময়ে প্রবেশ করেছে। এটা এমন এক সময় যখন একই সাথে পণ্য ও সেবার উৎপাদন এবং ভোগ ও বিনিয়োগ উভয়ই লাগামহীনভাবে হ্রাস পায়। মন্দার দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে বর্তমানে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ের দিকে ঝুঁকছে, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা প্রচুর শ্রমিক তাদের কাজ হারাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব গত শতাব্দির '৩০-এর দশকের মহামন্দার সময়কার বেকারত্ব হারকেও হার মানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বেকারের সংখ্যা সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ২.৫ কোটি বলা হয়েছে। বিশেষত ট্যুরিজম বা পর্যটনশিল্প বন্ধ থাকায় হোটেল, এয়ারলাইন্স, রেস্তোরাঁর সাথে জড়িত প্রচুর মানুষ কাজ হারিয়েছেন বিশ্বজুড়ে। কেবল এয়ারলাইন্স খাতেই সারা বিশ্বে ২.৫ কোটি মানুষের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বৃহত্তর পর্যটন খাতকে হিসেবে আনলে সংখ্যাটা ঠেকছে প্রায় ৮ কোটিতে। বিশ্বজুড়ে ৪৫% মানুষ সেবা খাতে কর্মরত, যেখানে গ্রাহকের সাথে সরাসরি ইন্টারেকশন বা যোগাযোগের প্রয়োজন হয়।লক ডাউনের ফলে সম্পূর্ণ সেবাখাত হুমকির সম্মুখীন।এদিকে আবার যুক্তরাজ্যের ৭০লাখ মানুষ চাকরি হারানোর আশঙ্কায় আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট সেবা খাতে কর্মরত ব্যক্তির প্রায় ৬০% চাকরি হারাতে পারেন। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ইতালিতে ৫২% মানুষ নিজের বা প্রিয়জনদের চাকরি হারানোর বিষয়ে আতঙ্কিত। মোদ্দা কথা হলো- বিশ্বজুড়েই প্রচুর মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন এবং সেই তালিকা প্রতিনিয়ত বড়ই হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক চেয়ার লরা টাইসন বলছেন,"করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কাজের যান্ত্রিকিকরণকে ত্বরান্বিত করবে, ফলে মধ্যম দক্ষতার ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান কমবে এবং অধিক দক্ষতার কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে প্রবণতা রয়েছে তা আরও বাড়বে। ঐতিহ্যগতভাবে স্বল্প মজুরির সেবা সরবরাহকারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে। আর চাকরি ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রশিক্ষণের গুরুত্ব বাড়বে।" এমন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের গায়েও। বাংলাদেশের ৪৩% শ্রম বৃহত্তর কৃষিখাতে নিয়োজিত। গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে ১৬%, খুচরা ব্যাবসায় ১১%, পরিবহণ ও নির্মাণ খাতে যথাক্রমে ১০ ও ৭%। এছাড়া প্রায় ১.২৫ কোটি শ্রমিক বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখছেন। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে চাপের কারণে এই প্রবাসী শ্রমিকরা সবার আগে আক্রান্ত হবেন। ইতোমধ্যে অনেকে হয়েছেনও। একই সাথে যেহেতু তেলের দাম কমেছে, তাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে ফিরতে পারেন। এছাড়া বিজিএমইএ-এর নিশ্চয়তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের আরএমজি খাতে কর্মরত প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। শুধু তাই নয় লে-অফ না করা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারখানা শ্রমিকদের মজুরির শুধুমাত্র ৬০% দেওয়ার অনুমতি নিয়ে একই সাথে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে ফেলছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এ বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাবেক গভর্নর ড.সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "মানুষকে উদ্যোগপ্রবণ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এতে করে বৃহৎ শিল্পে নিশ্চিতভাবেই যন্ত্রায়ণ বাড়বে। কাজেই এদের কর্মসংস্থানের জন্য শ্রমঘন এসএমই-কে বাড়িয়ে তোলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সরকারের সাহায্যের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদেরকেও বসে না থেকে এসএমই-এর মাধ্যমে নিজের ও অন্যদের কর্মসংস্থানে সচেষ্ট হতে হবে।" প্রথাগতভাবেই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত বা গ্র্যাজুয়েটদের মাঝে বেকারত্ব, জাতীয় বেকারত্ব হারের আড়াই গুণ অর্থাৎ প্রায় ১০ ভাগ। মোট বেকারত্ব করোনার প্রভাবে ২৭ লাখ থেকে বেড়ে গিয়ে পৌঁছেছে ১ কোটিতে। কাজেই গ্র্যাজুয়েট বেকারত্ব যে এই দুষ্কালে আরও বাড়তে পারে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর মূল কারণ আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটদের হোয়াইট-কলার জবের প্রতি বেশি আগ্রহ। করোনার ফলে অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়েছে, সেটি যে করোনার সাথে সাথেই বিদায় নেবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং ২০০৮ সালের মন্দার মতো চাকরির বাজার পুনরায় ফিরিয়ে আনতে আরও ২-৩ বছর সময় লাগতে পারে।সেক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা প্রচুর বেড়ে যাবে। এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে বিশ্বজুড়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের কোয়ালিফিকেশন বৃদ্ধির আশায় প্রচুর নতুন তালিকাভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। কিন্তু কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিই যথেষ্ট হবে না। করোনা পরবর্তী বিশ্বে প্রতিযোগিতাপ্রবণ চাকরির বাজারে টিকে থাকতে আরো কষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষিখাত বিশাল এক সম্ভাবনার নাম।আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্যে স্বাভাবিকভাবেই এ খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে, দক্ষ লোকবলের চাহিদা বাড়বে। এ সুযোগ নতুন গ্র্যাজুয়েটরা লুফে নিতে পারে।পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতেও পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয়তাও বাড়বে। এটিও হতে পারে কর্মসংস্থানের অন্যতম মাধ্যম। এর বাইরে শিক্ষা ও আইটি খাতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হবে। এ বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে গ্র্যাজুয়েটরা যদি নিজেদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারেন তাহলে চাকরির বাজার তাদের জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে।
কিছুদিন বন্ধই থাকবে। কিন্তু তা বলে চাকরির বাজার অপেক্ষা করবে না। তাই ধীরে ধীরে রিক্রুটমেন্ট যখন শুরু হবে, তখন যে বিষয়গুলো কম-বেশি আপনার মাঝে খোঁজা হবে তা হলো- • পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, পাশাপাশি চাকরিপ্রার্থীদের নিজেদের যোগ্যতাগুলোকে ক্রমাগত আপডেট ও রিফ্রেশ করতে জানতে হবে, সবসময় সবকিছু থেকে শেখার মানসিকতা থাকতে হবে। • চাকরির ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। সামনের দিনগুলোতে এদের গুরুত্ব আরও বাড়বে। মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা চাকরির বাজারে বিশাল ভূমিকা রাখবে। • চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জ্বালানী হিসেবে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ডেটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কাজেই ডেটা লিটারেসিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ডেটা লিটারেট প্রার্থীদের চাহিদা যে অন্য চাকরি প্রার্থীদের থেকে বেশি হবে, তা বলাই বাহুল্য। • বিশ্বজুড়ে বেহাল দশার অর্থনীতিকে পুনর্গঠনে যে দক্ষতাটির উপরে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হবে তা হলো ক্রিটিকাল থিংকিং। সকল তথ্যই নির্ভরযোগ্য হবে না। নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক পলিসি নির্মাণে ক্রিটিকাল থিংকিং চাকরিদাতাদের কাছে সোনার হরিণ হয়ে উঠবে। • নেতৃত্বগুণ এবং আবেগিক বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ গুরুত্বপূর্ণ চাকরিদক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হবে।সামাজিক দূরত্ব ও বাড়িতে বসে কাজ করা অদূর ভবিষ্যত আরও বিস্তর রূপ ধারণ করতে পারে, করোনা থেকে প্রাপ্ত আমাদের সচেতনতার কল্যাণে। সেক্ষেত্রে নিজের ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারা, অন্যের ইমোশন বুঝতে পারা, অধীনস্তদের থেকে সর্বোচ্চটা বের করে নিয়ে আসার মতো নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন চাকরিপ্রার্থীরা নিঃসন্দেহে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন। গত এক দশকে চাকরির বাজার ক্রমাগত প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এই মহামারির গতি তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ ক্রমেই নো-টাচ ইকোনমি ও কমিউনিকেশনে ঝুঁকে পড়ছে। কাজেই বেসিক প্রযুক্তি জ্ঞানের পাশাপাশি বিগ ডেটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(এআই), ভার্চুয়ালরিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি সম্পর্কেও চাকরিপ্রার্থীদের জ্ঞানের দাবী চাকরিদাতারা করতেই পারেন। এছাড়া ভবিষ্যতে মহামারি প্রতিরোধী বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়তে রোবটিক্সের প্রতি মনোযোগ বাড়তে পারে। এই প্রযুক্তিভিত্তিক বিষয়গুলোর উপর যথাযথ জ্ঞান যেকোনো চাকরিপ্রার্থীকে ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাস ও কোর্সগুলো ক্রমেই অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়ছে। যা মাস কয়েক আগে ভাবাও যেত না। শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়গুলো নিজেদের কোর্সের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত করা প্রয়োজন যেন শিক্ষার্থীরা করোনা পরবর্তী প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে প্রবেশ করার আগে প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো অর্জনের সুযোগ পায়। দিনশেষে এটাই বর্তমান বাস্তবতা যে, শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করে অর্থনীতিকে সচল রাখা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম দায়িত্ব। সর্বোপরি গ্র্যাজুয়েট, দক্ষ চাকরিপ্রার্থী থেকে শুরু করে একেবারে অদক্ষ মানুষটি যিনি শ্রমবাজারে প্রবেশ করবেন, সবার ক্ষেত্রেই মানসিকতার পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে করোনা পরবর্তী এই নতুন প্রেক্ষাপটে। তথ্যসূত্রঃ
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |