সাদিক জাফরুল্লাহ সাদিক জাফরুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালিয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৯১তম ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্র। স্নাতকোত্তর করেছেন সুইডিশ ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচারাল সাইন্সেস থেকে। বর্তমানে কাজ করছেন স্টকহোমে অবস্থিত গোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপ হেডকোয়ার্টার্সে। ছাত্রাবস্থায় কাজ করেছেন ইএসসিসহ বিভিন্ন ইয়ুথ অর্গানাইজেশনে, ইন্টার্নশিপ করেছেন আইএলও'র থাইল্যান্ডে অবস্থিত এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল অফিসে। আগ্রহ আছে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে। নতুন জায়গায় ঘুরতে এবং বাংলা গান শুনতে পছন্দ করেন। তিনি লিখেছেন ইউরোপে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও শিক্ষাবৃত্তি লাভ করা সংক্রান্ত কিছু প্রচলিত প্রশ্ন নিয়ে। ১. একটি অপ্রচলিত প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। যখন আপনি অর্থনীতি বিভাগে প্রথম ভর্তি হন, তখন কি স্নাতক শেষ করার পরে বিদেশে পড়াশোনা করার মতো কোনো পরিকল্পনা ছিলো? একদম না। ইচ্ছা ছিল আইন বিভাগে পড়ব, আইনজীবী হব। এজন্যই মুলত ডি ইউনিটের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু কন্ডিশন ফিলআপ না হওয়ায় আইনে পড়া হলো না। সবার পরামর্শে অর্থনীতি বিভাগকে বেছে নিয়েছিলাম। সেক্ষেত্রেও আসলে বিদেশে পড়তে যাবার পরিকল্পনা শুরুতে ছিল না। ২. বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন, আপনি কীভাবে নিজেকে এর জন্য প্রস্তুত করলেন? আসলে বিদেশে পড়তে যাওয়াকে কেন্দ্র করে কখনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। বিভিন্ন ভলান্টারি কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম, বিভিন্ন ক্লাব এবং ভলান্টারি প্রতিষ্ঠানের সাথে বিভিন্ন কাজ করতাম। অর্থনীতি চর্চা কেন্দ্রেও কাটিয়েছি বেশ কিছুটা সময়। আনন্দ পেতাম বলে কাজ করতাম। এবং এগুলো কাজে জড়িত থাকায় কিছু স্কিল ডেভেলপ করার সুযোগ হয়েছিল। আমি মনে করি এসব কাজে যুক্ত থাকাটা আমার উচ্চশিক্ষার আবেদনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। অনেক মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে, অনেক অপার্চুনিটি সম্পর্কে জানা হয়েছে, যেগুলো আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। ৩. স্কলারশিপ সহ বিদেশে পড়াশোনার জন্য সিজিপিএ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সিজিপিএ কত এর মধ্যে থাকাটা আপনি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন? এই প্রশ্নটা সম্ভবত সকলের মনেই থাকে। উত্তরটাও হয়ত অধিকাংশেরই জানা। আমার অভিমত হল, সিজিপিএ-৩ এর অধিক থাকা সকলেই স্কলারশিপ পাবার যোগ্য। কিন্তু দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে আবদনের শর্ত ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। মনে রাখতে হবে, সিজিপিএ স্কলারশিপ ইভ্যালুয়েশনের একমাত্র ক্রাইটেরিয়া নয়। সমান গুরত্বপূর্ণ হতে পারে স্টেটমেন্ট অফ পারপাস, রিকমেন্ডেশন লেটার, পূর্বের গবেষনা অভিজ্ঞতা, কাজের অভিজ্ঞতা, ইত্যাদি। একটা ভারসাম্যপূর্ণ আবেদনের গুরুত্ব অনেক বেশি। অনার্সে আমি সিজিপিএ ৩.৩৮ পাই, যা আমার স্কলারশিপ আবেদনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে হ্যাঁ, ভালো সিজিপিএ থাকলে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকা যায় নিশ্চিত। অর্থনীতি বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সিজিপিএ-কে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং ভালো করতে না পারলে হতাশায় পড়ে যায়। আমি নিজেও বেশকিছুটা সময় মনকষ্টে ভুগেছিলাম কম সিজিপিএ থাকার কারণে। যেটা কিনা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্কিল ডেভেলপ করার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটা মোটেই কাম্য নয়। পড়ালেখাটা যেমন ঠিকভাবে করা দরকার, ঠিক সেভাবে নিজের পছন্দ অনুযায়ী এক বা একাধিক টেকনিকাল স্কিল গড়ার পিছেও সময় দেয়া দরকার বলে আমি মনে করি। ৪. ইউরোপে স্কলারশিপের আবেদনের জন্য আপনার প্রথম পদক্ষেপটি কী ছিল? প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমি ফেসবুকে সকল উচ্চশিক্ষা বিষয়ক গ্রুপগুলোতে যুক্ত হই। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্কলারশিপ সম্পর্কে একটা ধারনা নেয়ার চেষ্টা করি। তারপরে স্কলারশিপগুলোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটগুলোতে আবেদনের শর্তগুলো দেখে নেই এবং বোঝার চেষ্টা করি যে কোন কোন প্রোগ্রামগুলো আমার প্রোফাইল ও পছন্দের সাথে মিলে। সে অনুযায়ী দরকারি কাগজপত্র জোগাড় করা শুরু করি। এভাবেই মূলত আবেদনের শুরুটা হয়েছিল। ৫. আপনি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন- আইএলও এবং গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপসে ইন্টার্নশিপ করেছেন। এই ধরনের ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়াটি কি জানতে পারি? এজাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আবেদন ও সিলেকশন প্রক্রিয়া সাধারণত বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ভ্যাকেন্সি এনাউন্সমেন্ট দেয় এবং সে নির্দেশাবলি অনুযায়ী আবেদন করতে হয়। বিভিন্ন ধাপে প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করা হয়। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল একটা মার্জিত সিভি এবং কাভার লেটার তৈরি করা। শর্টলিস্টেড হবার জন্য এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। পরবর্তী ধাপগুলোতে অনলাইনে লিখিত পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউ দিতে হয়। প্রতিষ্ঠান ভেদে কিছু পরিবর্তন থাকতে পারে। ৬. আমরা সবাই জানি বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য বৃত্তি লাভ করা কতটা কঠিন, বিশেষত ইউরোপে। আপনি ইউরোপের ৩ টি বিখ্যাত স্কলারশিপ পেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। এই স্কলারশিপগুলো পাওয়ার জন্য কোন জিনিসগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন? আমি মনে করি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো স্টেটমেন্ট অফ পারপাস (এসওপি) অথবা মোটিভেশন লেটার। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফরম যেখানে প্রার্থীরা তাদের উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা, প্রয়োজনীয়তা এবং যোগ্যতা সম্পর্কে যুক্তি দিয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে একটা এসওপি হতে পারে স্কলারশিপ পাবার প্রধান দরজা। দ্বিতীয়ত, রিকমেন্ডেশনকেও খুব গুরুত্ব দেয়া হয় ইভ্যালুয়েশনে। প্রার্থীর যোগ্যতা ভেরিফাই করার এটাই মাধ্যম। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো, একটা ভারসাম্যপূর্ণ আবেদন যেখানে প্রার্থীর যোগ্যতাগুলো সহজে দৃশ্যমান হবে, এসওপির সাথে রিকমেনন্ডেশন লেটার, সিভি ও অন্যান্য কাগজগুলো সামঞ্জস্যপূর্ন হবে। এটি বেশ কার্যকরী, অনেকেরই সামঞ্জস্যতা না থাকায় বাদ পড়ে যেতে হয় অনেক ভালো প্রোফাইল থাকার পরেও। ৭) সুইডিশ ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচারাল সাইন্সেস (এসএলইউ) কেই কেনো বেছে নিলেন? আমি মূলত সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিলেটেড বিষয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। এসএলইউ এদিক দিয়ে বেশ আগিয়ে এবং ভালো ধরণের গবেষনা হচ্ছে। এগ্রিকালচার সাইন্সে বিশ্ব র্যাংকিং-এ ৩য় অবস্থানে আছে দেখে অনেক আগ্রহী হয়েছিলাম। পাশাপাশি সাবজেক্ট কনটেন্ট ও সিলেবাস দেখে মনে হয়েছিল পড়ালেখার চাপ কম হবার কথা এবাং সহজ হবে ভেবেছিলাম। এছাড়াও আমি সুইডেনের আরো দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলাম। উপসালা এবং লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেগুলোতে আমি সিলেক্টেড হইনি। কিন্তু উল্লেখ করা প্রয়োজন, এসএলইউতে পড়ে আমি সন্তুষ্ট। এটি ছোট বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াতে অনেক অপর্চুনিটি লুফে নেবার সুযোগ থাকে। একটা সিক্রেট বলে দেই। গ্লোবাল সুইড এওয়ার্ড পাবার ক্ষেত্রে আমাকে তুলনামুলক অনেক কম শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। যেহেতু প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধুমাত্র একজন শিক্ষার্থীকে এটি দেয়া হয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কম, সেহেতু কম্পিটিশনও কম ছিল। ৮) বিদেশে পড়াশোনা করার আবেদন করতে কোন কোন যোগ্যতা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
আগেই আবেদনের কন্টেন্ট সম্পর্কে বলেছি, কোন জিনিসগুলো দরকারি সেসব নিয়ে বলেছি। আবেদন করার ক্ষেত্রে ইংরেজি রাইটিং স্কিলটা খুব দরকারি। কারন সুন্দর এসওপি লেখাটা একটা ক্রিয়েটিভ কাজ। সুন্দর করে একাডেমিক সিভি তৈরী করাটা জরুরী। এটেনশন টু ডিটেইলসটা খুব জরুরি। কোনো স্কলারশিপ এর আবেদনের সময় ওয়েবসাইটে থাকা সকল ইনফরমেশন খুব মনোযোগের সাথে পড়তে হবে। এবং বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে তারা আসলে কি চাচ্ছে, কেমন ধরনের শিক্ষার্থীদের চাচ্ছে। যেমন, কিছু স্কলারশিপ একান্তই তরুণ গবেষকদের জন্য, কিছু স্কলারশিপ তরুণ উদ্যোক্তা বা কর্মজীবীদের জন্য। এগুলো বুঝে নিজের আবেদনটি ঠিক সেভাবে সাজাতে হবে। আরেকটি জিনিস খুব প্রয়োজন। ধৈর্য্য। আসলে অনেক সময় দিতে হয় একটা কোয়ালিটি আবেদনের ক্ষেত্রে। অনেকেই ধৈর্য্য রাখতে পারে না। কোন রকমে আবেদন করে দিয়ে আশাহত হয় সফল না হলে। মনে রাখা দরকার, এটা একটা কঠিন যুদ্ধ – সকল দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের সাথে। সুতরাং, একটু ডেডিকেশন থাকাটা জরুরী। ৯) আপনি কি বাংলাদেশি হিসেবে সুইডেনে বাস করতে গিয়ে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত তেমন কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমি মনে করি সত্যি সত্যি পড়ালেখায় আগ্রহী হলে বিদেশে পড়ালেখা করাটা খুব দারুণ একটা সুযোগ। যারা মুলত পড়ালেখায় নয় বরং বিদেশে মাইগ্রেট করায় বেশি আগ্রহী, তাদের জন্য বিদেশের এই পড়ালেখার সিসটেম খুব কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে যারা স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশে পড়তে আসেন তাদেরকে অনেক সাফার করতে হয়। পার্টটাইম কাজ ও পড়ালেখা একসাথে চালানোটা চাট্টিখানি কথা না। অনেককেই ড্রপ-আউট হতে হয় চাপ সামলাতে না পেরে। তবে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশে আশা উচিত না। তারা যথেষ্ট মেধাবী। চেষ্টা করলেই ইনশাআল্লাহ স্কলারশিপ পেয়ে আসতে পারবে। ১০. অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের অনেকটা জুড়েই থাকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা। তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কি? অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য আসলে বিস্তৃত সুযোগ আছে ইউরোপে। নানা ধরনের স্কলারশিপের সুযোগ আছে। আছে স্পেশালাইজেশন করার মত স্পেসিফিক সাবজেক্টে পড়ার সুযোগ। যদি সত্যিই ইচ্ছা থেকে থাকে তাহলে কোমর বেঁধে আবেদনের কাজে নেমে যেতে হবে। রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী নিজের প্রোফাইল সাজাতে হবে। আল্লাহ চাইলে একটা না একটা স্কলারশিপ ধরা দিবে অবশ্যই।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |