ইয়াসিন শাফি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আজ বেশ ক’বছর ধরেই। ২০১৬ সালে যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল যাবে তখনই আন্দোলন ও অসন্তোষ দানা বাধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁরা এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান। কিন্তু নানা কারণেই চলমান এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত থেকে যায়। বর্তমানে টিএসসিতে মেট্রোরেলের স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হলে সেই পুরনো বিতর্ক আবার নতুন রূপে ফিরে আসে। অনেকেই টিএসসিতে স্টেশন নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করেন আবার অনেকেই খোদ মেট্রোরেলের রুট বদলানোর দাবি তোলেন। সিদ্ধান্তহীনতার এই দোদুল্যমান সময়ে আন্দোলন কোন লক্ষ্যকে মাথায় রেখে করা উচিত তা জানতে হলে আমাদের জানতে হবে সেই ২০১৬ সালের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতা। ইএসসির আজকের ব্লগে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ২০১৬ সালের রুট বদলাও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইয়াসিন শাফি। মৌলিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেল গেলে ভালো হবে নাকি খারাপ হবে সেই আলোচনা করার আগে মৌলিক সমস্যাটা চিহ্নিত করা জরুরি। যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে যখন প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয় এবং তাতে কারো ভূমি অধিগ্রহণ করার দরকার পড়ে, তখন সেই ভূমির মালিকের সাথে আলাপ করার দরকার পড়ে। তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। আবার উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য এটা একটা রীতি যে- সেই প্রকল্পটি যে এলাকায় হবে, সেই এলাকার পরিবেশ এবং মানুষজনের উপর কীরকম প্রভাব পড়বে সেটা যাচাই করা। ওই এলাকার অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় করা, তাদের আশংকাগুলোর কথা শোনা, সেগুলোকে আমলে নিয়ে প্রকল্প সাজানো, তাদের পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দিয়ে এতো বড় একটা প্রকল্প গেলে কার সাথে আলাপ করা উচিত? কাদের কাদের জীবন এবং জীবিকায় প্রভাব পড়বে? তাদের মতামত নেয়া হয়েছে কিনা সেটা এখানে জরুরি প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো কেবল একটা জমি না যে জমির মালিকের সাথে কথা বললেই হয়ে গেলো। এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আমার মতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার গোষ্ঠি হচ্ছে তার শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের মত একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে তাই শিক্ষার্থীদের মতামত নেয়াটা খুবই জরুরি। ইন্টারনেটে মেট্রোরেল প্রকল্পের যে কাগজপত্র পাওয়া যায় তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কোন আলাপ হওয়ার আলামত পাওয়া যায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও জানে না কারো সাথে আদৌ মতবিনিময় হয়েছে কিনা, হলে কাদের সাথে হয়েছে, কী প্রক্রিয়ায় তাদের বাছাই করা হয়েছে। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত নেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করা হয় নাই- এটাই এই পুরো আলোচনার মৌলিক সমস্যা। একারণেই শিক্ষার্থীরা ২০১৬ সালে ক্ষুব্ধ ছিলো, এবং ২০২০ এও তারা একইরকম ক্ষুব্ধ। চাপ প্রয়োগের স্থান চিহ্নিত করা পাবলিক পলিসির আলোচনায় “ভেন্যু শপিং” নামে একটা ধারণা আছে। আপনি একটা ইন্টারেস্ট গ্রুপ হিসাবে আপনার প্রস্তাব নিয়ে কোথায় কোথায় আলোচনা করবেন সেটা ঠিক করা জরুরি। একইভাবে আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আপনি কাদের ওপরে চাপ প্রয়োগ করবেন সেটা চিহ্নিত করা জরুরি মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছেই শিক্ষার্থীরা দাবিদাওয়া পেশ করে অভ্যস্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে কাঠামো থেকে সুবিধাভোগ করেন, তার বিপক্ষে কোন মতামত দেবেন কিনা, কিংবা নিজেদের শক্তি এবং সময় তাদেরকে আন্দোলনে শামিল করানোতে খরচ করাটা খুব কাজের কিছু কিনা সেটা নিয়ে আন্দোলনকারীরা ভাবতে পারেন। মেট্রোরেলের প্রকল্পের মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিদেশি দাতা সংস্থা রয়েছে। তাদের ওপরে চাপ প্রয়োগ করাটা কাজের হতে পারে কিনা সেটা ভেবে দেখতে পারেন আন্দোলনকারীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন এই আন্দোলন নিয়ে আলাপ হচ্ছে, মূলধারার গণমাধ্যমেও এই আলাপটি নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক যোগাযোগের খেলা এই আন্দোলনকে জনগণের কাছে ও গণমাধ্যমের কাছে প্রচার করার সময় খুব স্পষ্ট হতে হবে। আন্দোলনের স্লোগান স্পষ্ট ও সহজবোধ্য হওয়া উচিত। একটাই মূল বক্তব্য থাকা উচিত। সেটা সবার একইভাবে প্রচার করা উচিত। এটা না হলে জনসাধারণের কাছে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হতে পারে। ২০১৬ সালে আন্দোলন শুরু হয় ‘নো মেট্রো ইনসাইড ডিইউ’ নামে। কিন্তু এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে একটা গোষ্ঠি দল বেঁধে ‘মেট্রো চাই’ নামে লেখালেখি শুরু করে। এখন মানুষের মন কীভাবে কাজ করে? যখন আপনি দেখেন যে কেউ একজন বলছে ‘মেট্রো চাই’, এবং আপনি জানেন যে সাধারণ ছাত্ররা তাদের বিরোধীপক্ষ, তখন আপনি ধরে নেন যে সাধারণ ছাত্ররা মেট্রো চায় না। ছাত্ররা কিন্তু ঢাকা শহরে মেট্রোর বিরোধিতা করে নাই, তারা চেয়েছিলো রুটটা যাতে তাদের ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে না যায়। তখন ২০১৬ সালে স্লোগান ঠিক করা হলো ‘রুট বদলাও’। এটা সহজ এবং কার্যকরী স্লোগান ছিলো। কিন্তু এটাকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে সময় দরকার ততো সময় আন্দোলনটা টিকে থাকেনি। এখন আন্দোলন হলেও একটা সংগঠিত শক্তি সেটার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে থাকবে। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যোগাযোগের খেলাটা জিততে হলে লম্বা সময় ধরে একটা সহজ বক্তব্য বারবার বলে যাওয়াটা জরুরি। এই আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত হবেন, তারা হয়তো খুব ভালোমতো ছবিটা দেখতে পারছেন যে এই ক্যাম্পাসে মেট্রোরেলের একটা স্টেশন হলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর কীরকম প্রভাব পড়বে। কিন্তু সব শিক্ষার্থী যে একই ভাবে ছবিটা দেখতে পাবেন তা না। তাদেরকে সক্রিয়ভাবে আপনার আন্দোলনের সাথে একাত্ম করতে হলে, তাদেরকে ছবিটা দেখাতে হবে। ২০১৬ সালের আন্দোলনের সময়ে মেট্রোরেলের কোন ভালো মডেলের ছবি বা ভিডিও ইন্টারনেটে ছিলো না। যা ছিলো তা বাস্তব থেকে অনেক দূরে ছিলো। এখন মেট্রোরেলের এবং স্টেশনের মডেলের ভালো ভিডিও আছে, দেখলে বোঝা যায় এটার ব্যাপ্তি কীরকম হবে। এই ছবি বা ভিডিও ছাত্রদের দেখাতে হবে। যারা ছবি আঁকেন তারা ছবি আঁকতে পারেন, কেউ থ্রিডি মডেলিং করতে পারলে মডেলিং করে দেখাতে পারেন- এটা দেখতে কেমন হবে। অনেক কথার চাইতে ছবি বা ভিডিও ছাত্রদেরকে বেশি নাড়া দিতে পারে। আন্দোলনের ভাষায় কোন পর্যায়েই মেট্রোরেলে যারা চড়বেন বা টিএসসি স্টেশনে যারা নামবেন তাদের ছোট করে কোন ধরনের কথা বলা উচিত না। এইরকম এলিটিস্ট আচরণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক যৌক্তিক আন্দোলনের প্রতি সাধারণ জনগণ কোনরকম সহানুভূতি বোধ করে না। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এরকম কিছু করা ঠিক হবে না। আন্দোলনের মিত্র বাড়ানো আন্দোলন করার সময় ‘আমরা বনাম তারা’ এরকম একটা মনোভাব কাজ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আন্দোলনকে শক্ত করার জন্য মিত্র খুঁজে বের করা জরুরি। এখানে আন্দোলনের উদ্দেশ্যের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে পারেন এমন সব ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সাথে মিত্রতা তৈরি করা যেতে পারে। যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এই আন্দোলনের দাবির সাথে একমত হতে পারেন। গণমাধ্যম কর্মী, স্থপতি, অ্যাক্টিভিস্ট ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে পারেন এমন লোকদের খুঁজে বের করা জরুরি। কথার কথা- এমন লোক সরকারের প্রশাসনের অভ্যন্তরেও থাকতে পারে, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত লোকও হতে পারেন। তাদের খুঁজে বের করা, যোগাযোগ করা, এবং এভাবে মিত্রদের একটা বলয় তৈরি করা সাহায্য করতে পারে। লম্বা দৌড়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়া যারা আন্দোলন করবেন তাদের টিকে থাকার ক্ষমতা থাকা খুব জরুরি। এই টিকে থাকার ক্ষমতাকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল প্রতিপক্ষকে চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা আর দ্বিতীয়টি হলো চাপ সহ্য করে টিকে থাকার ক্ষমতা। আন্দোলনকারীরা চেষ্টা করবেন নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের অ্যাক্টরদের ওপর চাপ তৈরি করার জন্য। যখন সরকার বা প্রশাসন দেখবে শিক্ষার্থীদের কথা না শোনার খরচ শোনার চাইতে বেশি, তখন তারা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে চাইবে। উল্টো দিক থেকে আন্দোলন থামিয়ে দেবার জন্য আন্দোলনকারীদের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ করা হতে পারে। তাদের ছাত্রত্ব নিয়ে, হলের সিট নিয়ে, পরিবারের ওপরে চাপ আসতে পারে। এখানে আন্দোলনকারীদের এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। লম্বা সময় ধরে আন্দোলনে টিকে থাকার মাধ্যমেই ছাত্রদের এবং জনগণের সমর্থন আদায় সম্ভব এবং যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব। সবশেষে, আন্দোলনটা স্টেশন নিয়ে হবে নাকি রুট বদলানো নিয়ে হবে- এই নিয়ে হয়তো নানা আলোচনা হয়েছে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাঝে, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। এই আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এতোকিছুর পরেও এটা হয়তো খেয়াল করা প্রয়োজন যে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেকদিন ধরে কোথাও জিতছেন না। তাদের একটা জয়ের বেশ প্রয়োজন। এই জয় তাদের সাহস দেবে ও মনোবল যোগাবে সামনের দিনগুলোর জন্য। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে হওয়া সকল যৌক্তিক আন্দোলনের জন্য শুভকামনা। ইয়াসিন শাফি প্রাক্তন শিক্ষার্থী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৬ সালের মেট্রোরেলের রুট বদলাও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |