রিয়াদুস সালেহীন জাওয়াদ ২৫ অক্টোবর,২০১৯। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেসরকারিকরণ এবং ক্রমবর্ধমান জীবন যাপনের খরচের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পুরো চিলি জুড়ে এক মিলিয়ন মানুষ একযোগে রাস্তায় নেমে এসেছিলো। সাবওয়ের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে স্কুল শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এক আন্দোলন এতোটাই তীব্র এবং সহিংস হয়ে ওঠে যে প্রেসিডেন্ট পিনেরা সান্তিয়াগোর রাস্তায় সেনাবাহিনী নামাতে বাধ্য হন। একই সময়ে আন্দোলনের ঢেউ উঠতে থাকে আলজেরিয়া, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, মিশর, ফ্রান্স, জার্মানি, হাইতি, হন্ডুরাস, ইরান, লেবানন এবং সুদানে। এই সকল আন্দোলনেরও মূলে ছিলো অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জীবনমানের অবনমন। কিন্তু একই সময়ে প্রায় সারা পৃথিবী জুড়ে একই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে ওঠাটা নিতান্তই কাকতালীয় নয়। এই সকল দেশ গত প্রায় চার দশক ধরে একই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে, তাত্ত্বিকরা যেই ব্যবস্থাকে “নব্যউদারনীতিবাদ” হিসেবে অভিহিত করেন। বর্তমান অর্থনৈতিক আলোচনায় নব্যউদারনীতিবাদকে প্রায়ই একটি “ঐতিহাসিক অনিবার্যতা” হিসেবে তুলে ধরা হয়। নব্যউদারতাবাদীরা অ্যাডাম স্মিথের রেফারেন্স টেনে প্রায়ই বলার চেষ্টা করেন যে, মানুষকে যদি কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া রেখে দেয়া হয় তবে নিজের স্বভাবের কারণে মানুষ অনিবার্যভাবে একটি নব্যউদারতাবাদী আর্থ-সামাজিক অবস্থা সৃষ্টি করবে। এই বেদবাক্যটি আদৌ সত্য কি না এবং নব্যউদারনীতিবাদের ঐতিহাসিক এবং বর্তমান প্রভাবগুলো বোঝার জন্য নব্যউদারনীতিবাদের শৈশবের ঐতিহাসিক অবস্থা বোঝা প্রয়োজন। মন্দা, যুদ্ধ ও একটি গণদাবী ১৯২৯ সালের ২৯ অক্টোবরের আগে আমেরিকার সাধারণ মানুষ হয়ত চিন্তাও করতে পারেনি পরের বছরগুলো তাদের জীবনে কি পরিমাণ কষ্ট নিয়ে আসতে পারে কারণ ১৯২০-এর পুরো দশক জুড়ে ছিলো অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি। ১৯২০-২৯, মাত্র নয় বছরে আমেরিকার জাতীয় সম্পদের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিলো। কিন্তু এই উন্নয়নের প্রদীপের নিচেও যথেষ্ট পরিমান অন্ধকার ছিলো। উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমশ কমে যাচ্ছিলো এবং সাধারণ শ্রমিকদের বেতনের পরিমাণও ছিলো যথেষ্ট কম। এতে একদিকে স্টকের মূল্য তাদের প্রকৃত মূল্যের চাইতে অনেক বেশি হয়ে যায়, অন্যদিকে নিম্ন বেতনের কারণে শ্রমিকদের শুধুমাত্র বেঁচে থাকতেও প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছিলো। ব্যাংকগুলো বিশাল বিশাল ঋণ দিচ্ছিলো যেগুলো কোনোভাবেই আদায়ের ব্যবস্থা ছিলো না। অন্যদিকে খরা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষকরাও অর্থনৈতিকভাবে অসুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর শেয়ার ব্যবসায়ীরা এই বেশি দামে কেনা শেয়ারগুলো বিক্রি করা শুরু করলে এই নড়বড়ে অর্থনৈতিক অবস্থা তখন ভেঙে পরা শুরু করে। ২৯ অক্টোবর রেকর্ড ১৬ মিলিয়ন শেয়ার কেনাবেচার পর ওয়াল স্ট্রিটে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে, লক্ষ লক্ষ শেয়ার মূল্যহীন হয়ে পড়ে এবং যারা ধার করা অর্থে শেয়ার কিনেছিলেন তারা একদিনের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে যান। ভোক্তাদের খরচের পরিমাণ এবং নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে থাকায় কলকারখানা বন্ধ হওয়া শুরু হয়, বেকার হয়ে পরেন লাখ লাখ মানুষ। প্রেসিডেন্ট হার্ভার্ড হুভারের সরকারের বিশ্বাস ছিলো বাজার নিজেই এই অবস্থা থেকে নিজেকে বাঁচাবে। কিন্তু হয়েছিলো তার উল্টোটা। ১৫ মিলিয়ন মানুষ বেকার হয়ে পড়ে, আমেরিকার উৎপাদন হার নেমে আসে অর্ধেকে। ১৯৩৩ এর শেষ দিকে দেখা যায়, হাজার হাজার ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। এই প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপে। পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি এক মহামন্দার কবলে পড়ে। এরকম একটি সময়ে, ১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতা নেয়ার প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে তিনি কৃষিক্ষেত্রকে উজ্জীবিত করতে ভর্তুকি প্রদান করেন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করেন, মানুষের সঞ্চয় বাঁচাতে ফেডারেল ডিপোসিট ইনশিওরেন্স কর্পোরেশন এবং শেয়ার বাজারের অপব্যবহার যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে সেজন্য সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য রুজভেল্ট “নতুন ব্যবস্থা” বা “নিউ ডিল” প্রস্তাব করেন। এর আওতায় বাজারে নতুন নতুন নিয়ম প্রবর্তিত হয়, সরকারের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয় যেখানে প্রচুর মানুষ কর্মসংস্থান পায়। ১৯৩৫ এর বসন্তে দ্বিতীয় ধাপে সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা এবং সম্পত্তির ওপর নতুন কর ধার্য করা হয়। এই সকল ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনীতি যখন সমৃদ্ধির পথে তখনই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের পর মার্কিন অর্থনীতি প্রথমবারের মত সবাইকে পরিপূর্ণ কর্মসংস্থান দিতে সক্ষম হয়। একটি মুক্তবাজারের বদলে সরকারের সাথে চুক্তির মাধ্যমে, তুলনামূলক কম লাভে কর্পোরেশনগুলো উৎপাদন শুরু করে, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উৎপাদন ৩ বছরে দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং প্রথমবারের মত ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্য হ্রাস পাওয়া শুরু করে। যুদ্ধের শেষে আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারে দুইটি আলাদা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমেরিকা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয় আর ব্রিটেন নাৎসি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামো নিয়ে ধুকতে ধুকতে আবার যাত্রা শুরু করে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্রিটেন তার সকল উপনিবেশকে স্বাধীনতা প্রদান করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এর মধ্যেও আটলান্টিকের দুই পারে গণদাবী ছিলো এক ও অভিন্ন, কোনোভাবেই যাতে ’৩০ এর মহামন্দার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। মহামন্দা থেকে উত্তরণের জন্য জন মেইনার্ড কেইন্সের দেয়া সমাধানটি মোটামুটি সঠিক বলেই বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ ধরে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে যুদ্ধকালীন পূর্ণ কর্মসংস্থানের দৃষ্টান্তের কারণে পরবর্তী সময়েও সরকারের হস্তক্ষেপকে শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং অপরিহার্য হিসেবে দেখা হচ্ছিলো। ব্রিটেনে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছিলো আরো অনেক আগে থেকে। ১৯০৬-১৬ এর মধ্যে সীমিত আকারে বয়স্ক এবং বেকারদের জন্য ভাতা, স্বাস্থ্যবীমা এবং অসুস্থতার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা চালু করা হয়। এরই ধারাবাহিকতা যুদ্ধ পরবর্তী বছরগুলোতে বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। রুজভেলন্ট ১৯৪৪ সালে তার “স্টেট অফ দি ইউনিয়ন” ভাষণে প্রত্যেকটি মানুষকে কর্মসংস্থান, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসন এবং স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছিলেন। যদিও স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তা এখনো দেয়া সম্ভব হয় নি, রুজভেল্ট এবং তার উত্তরসূরী হ্যারি ট্রুম্যান “ন্যায্য ব্যবস্থা” বা “ফেয়ার ডিল”, জিআই বিল এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রসারের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যেই ছিলেন। অন্যদিকে অ্যাটলির সরকার পেনশন এবং স্বাস্থ্যবীমাকে সার্বজনীন করে, গণ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত “জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা” প্রতিষ্ঠা করে। এই সকল পরিবর্তন কিন্তু কোনো বিপ্লবের অংশ ছিলো না। রাজনীতিবিদ এবং অর্থনীতিবিদরা এইসব সংস্কারকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য বলেই মনে করতেন। এই ব্যবস্থাটির জনপ্রিয়তাও বজায় ছিলো বহুকাল ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেট সরকার ক্ষমতায় ছিলো টানা ২০ বছর এবং তাদের পরাজিত করতে রিপাবলিকানদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজয়ী জেনারেল আইজেনহাওয়ারের মত মানুষকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বানাতে হয়েছিলো। অন্যদিকে অ্যাটলির সরকার এতটা দীর্ঘমেয়াদী না হলেও পরবর্তী রক্ষণশীল সরকারগুলো গণরোষের ভয়ে তাদের কোনো প্রকল্পই বাতিল করতে পারেনি। একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্ম পশ্চিমা বিশ্বে যে মুহূর্তে কেইন্সিয়ান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জয়জয়কার ছিলো, মধ্য ইউরোপে তখন গড়ে উঠছিলো কেইন্সিয়ান ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের “নতুন ব্যবস্থা” এবং ব্রিটেনের ক্রমশ কল্যান রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া ক্রমেই কিছু অর্থনীতিবিদদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠছিলো। এই জার্মান-অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদরা রুজভেল্টের ব্যবস্থাপত্রে হিটলারের নাৎসিবাদ এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ছায়া দেখছিলেন। ১৯৪৪ সালে রুজভেল্ট যখন “স্টেট অফ দি ইউনিয়ন” ভাষণ দিচ্ছিলেন, অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিখ হায়েকের বই “Road To Serfdom” তখন ছাপাখানার পথে ছিলো। একই সময়ে প্রকাশিত হয় লুডউইগ ভন মিস-এর “Bureaucracy” এবং এক বছর পর প্রকাশিত হয় কার্ল পপারের “Open Society & Its Enemies”। নব্যউদারনীতিবাদের প্রথম বুদ্ধিবৃত্তিক রূপপ্রদান করেন এই তিনটি বই। কিন্তু নব্যউদারনীতিবাদের জন্ম ১৯৪৪ এর বহু আগে। ১৯৩০ সাল থেকেই ফ্রেডরিখ হাইক এবং তার সহকর্মীরা রুজভেল্টের “নতুন ব্যবস্থার” সমালোচনা শুরু করেন। তাদের মত ছিলো, বাজারে সরকারের এই ধরণের হস্তক্ষেপ মানুষের স্বাধীনতাকে হ্রাস করবে এবং হিটলার বা স্তালিনের মত একনায়কের জন্ম দেবে। এই অর্থনীতিবিদদের অনেকেই হিটলারের হাত থেকে বাঁচতে পশ্চিমা বিশ্বে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাই তাদের ভয়টি পুরোপুরি অমূলক ছিলো না। ১৯৩৮ সালে Colloque Walter Lippmann সম্মেলনে পশ্চিমা বিশ্বের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার সময় উইলহেলম রোপকে সর্বপ্রথম “নব্যউদারনীতিবাদ” বা “নিওলিবারেলিজম” শব্দটি ব্যবহার করেন। এই সকল বুদ্ধিজীবিদের মত ছিলো পশ্চিমা মূল্যবোধসমূহ হুমকির মুখে আছে এবং সেই কারণে ক্লাসিক উদারবাদকে নতুন যুগের জন্য নতুনভাবে ব্যখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। এই ধারণা থেকে পরবর্তীতে নব্যউদারতাবাদী বুদ্ধিজীবিগণ ১৯৪৭ সালে মন্ট পেলেরিন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে কেইন্সিয়ান ব্যবস্থার একটি পূর্ণ বিকল্প হিসাবে গড়ে না উঠলেও কেইন্সিয়ান ব্যবস্থার সমালোচনা নব্যউদারতাবাদীদের কাছ থেকে বেশ তুমুলভাবেই পাওয়া যাচ্ছিলো। কেইন্স বিশ্বাস করতেন, দারিদ্র্য, অপুষ্টি বা বৈষম্যের মত আর্থসামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান শুধুমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই করা সম্ভব, আর এই সমাধানের অগ্রদূত হিসেবে থাকবে প্রশিক্ষিত আমলারা, যারা জানেন তথ্যকে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। কেইন্স আরো বিশ্বাস করতেন যে সরকারের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পুঁজিবাদের উত্থান ও পতনের চক্র কমিয়ে আনা সম্ভব। অন্যদিকে নব্যউদারতাবাদীদের বিশ্বাস ছিলো বাজার-ই পারে সকল আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধান করতে। ক্লাসিক উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রেফারেন্স টেনে তারা দাবী করেন যে, বাজার-ই সম্পদ ব্যবহার ও বন্টনের সবচেয়ে কার্যকরী এবং স্বনির্ভর উপায় এবং সকল ভোক্তা ও বিক্রেতা যখন নিজের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করবেন, তখনই সমাজের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর ফলাফল আসা সম্ভব। এই অস্ট্রিয়ান ধারার অর্থনীতিবিদ ছাড়াও আরোও একটি অংশ রুজভেল্টের “নতুন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা বা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষিত এই অর্থনীতিবিদদের দুইটা স্বতন্ত্র প্রজন্ম বিদ্যমান। ফ্র্যাঙ্ক নাইট, জ্যাকব ভাইনার এবং লয়েড মিন্টসের মত অর্থনীতিবিদরা শিকাগো ধারার প্রথম প্রজন্মের অংশ। অস্ট্রিয়ান ধারার অর্থনীতিবিদগণ মূলত একটি ইউরোপিয়ান ধারণা থেকে “নতুন ব্যবস্থা”র সমালোচনা করেছেন। শিকাগো ধারার বুদ্ধিজীবিদের সমালোচনাগুলো ছিলো একটি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ছিলেন হেনরি সিমন্স। হেনরি সিমন্সের আলোচনার মূল বিষয় ছিলো মহামন্দার কারণ এবং ভবিষ্যতে এই ধরণের সংকট প্রতিরোধের উপায়। মহামন্দার কারণ হিসেবে সিমন্স কেন্দ্রীয় রিজার্ভের অক্ষমতাকেই দায়ী করেন, বাজারকে নয়। অন্যদিকে সিমন্স “নতুন ব্যবস্থা”-এর তীব্র সমালোচক ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন, বাজার অনিবার্যভাবেই অবস্থার উন্নতি করতে পারত। তবে সিমন্সের লেখায় বৈষম্য হ্রাসের জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করা, “প্রাকৃতিক মনোপলি”-এর সরকারি মালিকানা, বিজ্ঞাপনের পরিমান হ্রাস এবং বেশিরভাগ কল্যাণমূলক প্রকল্পের জন্য সমর্থন পাওয়া যায়। শিকাগো ধারার দ্বিতীয় প্রজন্মের এবং নব্যউদারবাদের মুখপাত্র হিসেবে যিনি সুপরিচিত তিনি হচ্ছেন মিল্টন ফ্রিডম্যান। হাঙ্গেরিয়ান অভিবাসীদের এই সন্তান ছাড়াও এই প্রজন্মের অংশ ছিলেন অ্যারন ডিরেক্টর, স্ট্রিগলার এবং গোরি বেকার। শিকাগো ধারার দ্বিতীয় প্রজন্মের এবং নব্যউদারনীতিবাদের দ্বিতীয় ধাপের শুরু হয় মিল্টন ফ্রিডম্যানের “নব্যউদারনীতিবাদ এবং এর সম্ভাবনা” প্রবন্ধের প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এই প্রবন্ধে ফ্রিডম্যান দাবি করেন যে ক্ল্যাসিক অর্থনীতির তত্ত্বগুলো মুক্তবাজারের জন্য যথেষ্ট নয়। ক্ল্যাসিক অর্থনীতিতে রাষ্ট্র শুধুমাত্র দুইটি কাজ করেঃ শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং বাজারের চুক্তিসমূহ যাতে লঙ্ঘিত না হওয়া, সেটি নিশ্চিত করা। কিন্তু ফ্রিডম্যানের মতে, একটি প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা বাজারে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষভাবে চেষ্টা করে উচিত। ফ্রিডম্যানের বিশ্বাস, এই প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা বাজারে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখবে এবং ভোক্তা ও বিক্রেতা প্রত্যেককেই সুরক্ষা দেবে। ফ্রিডম্যান যদিও বিশ্বাস করেন যে সরকারের আকার সীমিত রাখা উচিত কিন্তু তিনি এ-ও বিশ্বাস করেন যে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু ফ্রিডম্যান এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের অর্থনীতিবিদরা প্রথম প্রজন্মের শিকাগো ধারার অর্থনীতিবিদদের চেয়ে আরো বৈপ্লবিক তত্ত্ব প্রদান করা শুরু করেন, যেমন ফ্রিডম্যান সিমন্সের করনীতি এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পের ধারণার সাথে সম্মতি প্রদান করেননি। ৭০ এর দশকের আগেই ফ্রিডম্যান তার প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা থেকে সরে আসেন এবং মনোপলি এবং অলিগোপলি সমর্থন করা শুরু করেন এবং মুক্তবাজারের অন্যতম শত্রু হিসেবে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে চিহ্নিত করেন। ১৯৫১ সালে ক্ল্যাসিক অর্থনীতির সমালোচনা করলেও ১৯৭৬ এর মধ্যেই ফ্রিডম্যান পুনরায় নিজেকে একজন ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দেয়া শুরু করেন। স্মিথ থেকে ফ্রিডম্যানঃ একটি অবধারিত উপসংহার? যে সময়ে নব্যউদারবাদ অ্যাকাডেমিক আলোচনা থেকে মূলধারায় আসা শুরু করলো, সেই সময়েই শুরু হয়েছিলো মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধ। নব্যউদারবাদীদের মতে রুজভেল্টের “নতুন ব্যবস্থা”র বা ব্রিটেনের কল্যাণরাষ্ট্রের রূপরেখার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনো নীতিগত পার্থক্য ছিলো না। তাই তাদের চোখে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমালোচনার জন্য পশ্চিমা বিশ্বে একমাত্র উপযুক্ত নীতি ছিলো নব্যউদারবাদ। নিজেদের মতবাদকে ঐতিহাসিক বৈধতা প্রদানের জন্য তারা নব্যউদারবাদকে ক্ল্যাসিক উদারবাদের একটি অবধারিত প্রসার হিসেবে প্রচার করা শুরু করলেন আর ক্ল্যাসিক উদারবাদের সবচেয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথকে নব্যউদারবাদের “ধর্মপিতা” হিসেবে প্রচার করা শুরু করলেন। কিন্তু অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্বের সাথে ফ্রিডম্যানের বেশ গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়। যদিও স্মিথ বাজারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কমানোর পক্ষেই ছিলেন, তবুও তার মতে রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বিদ্যমানঃ বিদেশি আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করা, আভ্যন্তরীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বজায় রাখা যেমনঃ শিক্ষা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু ফ্রিডম্যানের মতে এই তৃতীয় দায়িত্বটি কল্যাণকর নয় কারণ “গুরুত্বপূর্ণ” প্রকল্পের আওতায় সকল ধরণের বিষয়ই আনা সম্ভব এবং সকল নিয়ন্ত্রণকেই বৈধতা প্রদান করা সম্ভব। মুক্তবাজারের বৈধতা প্রদানের জন্য নব্যউদারবাদীরা প্রায়ই স্মিথের মতবাদকে ব্যবহার করে থাকেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, স্মিথ মুক্তবাজারকে সমর্থন করেছিলেন কারণ মানুষকে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ছেড়ে দিলে স্বভাবগত ধর্মের কারণে সে এরকম একটি ব্যবস্থাই সৃষ্টি করবে। মানুষের প্রাকৃতিক ধর্ম নিয়ে স্মিথের বিশ্লেষণটি ছিলো পজেটিভ, নর্মেটিভ নয়। অর্থাৎ স্মিথ একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বলেছিলেন মানুষ তার সমাজকে সাধারণত মুক্তবাজারকেন্দ্রিকভাবে গড়ে তোলে এবং বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিক আলোচনা তার এই উপসংহারকে সঠিকভাবে মেনে নিতে পারে নি (আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বিনিময় প্রথাভিত্তিক বাজারব্যবস্থা স্মিথের উপসংহারকে সমর্থন করে না)। এছাড়াও, নব্যউদারবাদীদের মতে মানুষের আচরণ স্বভাবতই স্বার্থপর তাই কোনো পরিবেশে তাকে স্বাধীনতা দিলে সে স্বার্থপর আচরণই করবে এবং যদি সে কোনো স্বার্থহীন আচরণ করেও থাকে, সেটি তার পরিবার বা গোত্রের জন্য কারণ তার পরিবার বা গোত্র তারই একটি অংশ। স্মিথ বেশ পরিষ্কারভাবেই এটি বিশ্বাস করেন না। তার কাছে মানুষ কিভাবে আচরণ করবে তা নির্ভর করে মানুষের সহমর্মিতা, সাহায্যমূলক মনোভাব এবং নিজের স্বার্থের ওপর। মুক্তবাজারের পক্ষে নব্যউদারবাদীদের অন্যতম যুক্তি হলো স্মিথের অদৃশ্য হাতের তত্ত্ব। নব্যউদারবাদীরা বিশ্বাস করেন চাহিদা এবং যোগানের কারণে সকল সম্পদ সর্বোচ্চরূপে ব্যবহৃত হবে এবং সেহেতু মানুষের জীবনেও সর্বোচ্চ পরিমাণ কল্যাণ নেমে আসবে। কিন্তু পূর্বেই দেখা গিয়েছে স্মিথ বিশ্বাস করেন সকল মানুষের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নব্যউদারবাদীদের বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরকারের সীমাবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা। স্মিথের লেখাতে সরকারের সীমাবদ্ধতার কথা থাকলেও সেটি কোনভাবেই ফ্রিডম্যানের পর্যায়ের নয়। অন্যদিকে স্মিথের লেখায় নৈতিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্মিথ বেশ পরিষ্কারভাবেই বলেন যে মুক্তবাজার ব্যবস্থাটি যথার্থভাবে কাজ করার জন্য নৈতিক ব্যক্তিদের প্রয়োজন, যেই দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেয়া প্রয়োজন। নব্যউদারবাদীদের জন্য স্বার্থপরতা এবং লোভ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা। অন্যদিকে স্মিথ সমাজে ধনী এবং সফলদের আরাধনা এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি অবিচার এবং অবহেলা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। শুধু নব্যউদারবাদী অর্থনীতিবিদ নয়, মার্গারেট থ্যাচার, রোনাল্ড রেগান এবং পৃথিবীর অসংখ্য রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ এইসকল স্ববিরোধিতার পরেও স্মিথকে নিজেদের দর্শনের অংশ হিসেবে দাবী করেছেন এবং করে চলেছেন। জার্নাল থেকে মূলধারায় যদিও ৭০ দশকের শেষের দিকে পশ্চিমা বিশ্বে নব্যউদারবাদীরা নীতিনির্ধারণের পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া শুরু করেন, তাদের আদর্শের জন্য গণসমর্থন গড়ে তোলার চেষ্টাটি তারা শুরু করেছিলেন তার অনেক আগেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষের দিকে, তখনই পুরো বিশ্ব বুঝে গিয়েছিলো একটি মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধ অবধারিত। যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো একটি কঠোর সমাজতন্ত্রবিরোধীতা। ৫০ এর দশকে ম্যাককার্থিবাদের সময়ে এই অংশটি আরো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। নব্যউদারবাদীরা ম্যাককার্থিবাদকে সমর্থনই করতেন। এই সময়ে নব্যউদারবাদের ধারণা প্রচারের জন্য ধীরে ধীরে কিছু “থিংক ট্যাঙ্ক” গড়ে উঠতে থাকে, যার মধ্যে আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন, অ্যামেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, অ্যাডাম স্মিথ ফাউন্ডেশন, ফাউন্ডেশন ফর ইকোনমিক এডুকেশনের মত সংস্থাগুলো গড়ে ওঠা শুরু হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সংস্থাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করেন ব্যবসায়ীরা। এই সংস্থাগুলো হাইক বা ফ্রিডম্যানের খটোমটো তত্ত্বগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে আরো সহজ এবং সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা শুরু করে, যার ফলে ধীরে ধীরে নব্যউদারবাদের জন্য একটি সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৬০ এর দশকে দৃশ্যপটটি খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ম্যাককার্থিবাদের উচ্ছেদ এবং হিপ্পি সংস্কৃতির প্রসারের কারণে রক্ষণশীল আমেরিকার অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পরেন যাদের মধ্যে কমিউনিস্ট-বিরোধী অংশ এবং ধর্মভীরু এবং প্রথাগত চিন্তাচেতনার অধিকারী- এই দুইটি অংশ বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ৬৪ এবং ৬৫ সালে সিভিল রাইটস অ্যাক্ট এবং ভোটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার নিশ্চিত হলে রক্ষণশীলদের বর্ণবাদী অংশটি সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই সব অংশের মধ্যে মিশে যান নব্যউদারবাদীরাও। এই রক্ষণশীলরা, যাদের বেশিরভাগই বাস করতেন দক্ষিণের রাজ্যগুলোয়, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা নিয়ে এম্নিতেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই নব্যউদারবাদীদের সীমিত আকারের সরকারের ধারণাটি তাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার যখন দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বিদ্যালয়গুলোতে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের একসাথে শিক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে যান, বর্ণবাদীরা নব্যউদারবাদীদের “ব্যক্তিগত স্বাধীনতা” এর যুক্তি দিয়ে এই কাজে বাধা দেন যার ফলাফল এখনও আমেরিকায় লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে নব্যউদারবাদীরাও “নব্যউদারবাদ” নামটি ঝেড়ে ফেলে আরো সহজবোধ্য ধারণার দিকে এগিয়ে যান। তার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নৈতিক চরিত্রের মধ্যে অর্থনৈতিকক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিগত সাফল্যের ধারণা প্রবেশ করানো শুরু করেন। অন্যদিকে উইলিয়াম ভোলকার ফান্ড বা সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজের মত প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষণশীল ধারার এই সকল অংশকে একত্রিত করার চেষ্টা শুরু করেন। ব্রিটেনে বর্ণবাদের মত ঘটনা শুরুতে না থাকলেও তাদের সাম্রাজ্যের ইতির ফলে সাবেক উপনিবেশ থেকে ব্রিটেনে আসা অভিবাসীদের শ্রোত ব্রিটেনের শ্রমিক শ্রেণির চাকরির নিশ্চয়তার জন্য চিন্ত্রার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। অন্যদিকে কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর অর্থ এই অভিবাসীরা পাবে- এই ভয়ও ঘুরে বেড়াচ্ছিলো ইংল্যান্ডের বাতাসে। হঠাত করেই আটলান্টিকের দুই পারের মানুষ তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আর খুশি থাকতে পারছিলো না। মানুষের মনে ক্ষোভের বীজ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছিলো, যার ফলাফল হিসেবে নতুন দশকে আমরা ব্রিটেন ও আমেরিকার ক্ষমতায় পাই দুইজন কট্টরপন্থী গণদেবতাকে। উৎসঃ
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |