রুবায়েত আলম ডিজাইন: সুরভীতা বসাক ২০১৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতি বেশ কয়েকটি বড় ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, ক্রমবর্ধমান ভোক্তা ঋণের মাত্রা এবং ইউরোপীয় ও মার্কিন স্টক মার্কেটে অযৌক্তিক মূল্যায়নের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা মন্দার সময় অর্থ উপার্জনের উপায় খোঁজেন। বিদেশী সম্পত্তি সঠিকভাবে কিনলে ঝুঁকির সময় তা সংরক্ষণ করা যায় এবং নিজস্ব সম্পদে বৈচিত্র আনা যায়। অফশোর সম্পত্তি অসংখ্য অনন্য সুবিধার সাথে আসে - তাদের সবগুলিই আবার সম্পূর্ণভাবে আর্থিক প্রকৃতির নয়। এর অ্যানালাইসিস বুঝতে হলে প্রথমেই অফশোরিং সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দরকার। অফশোরিং হল ব্যবসায়িক অপারেশন ইউনিট ভিন্ন কোনো দেশে (সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে) স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া, যেখানে কম খরচে শ্রমবাজার বিদ্যমান। এখানে কোম্পানি বিশ্বব্যাপী খুচরা বিক্রেতা খোঁজে না; তার পরিবর্তে এটি উৎপাদন এবং উৎপাদনে সহায়ক অন্যান্য পরিষেবাগুলোর ব্যয় হ্রাস করার লক্ষ্যে কাজ করে। এই নতুন ব্যবসায়িক ইউনিট সেট আপ করা কোম্পানির জন্য বেশ লাভজনক, কারণ কোম্পানি এক্ষেত্রে তার মূল ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপগুলোতে আরও প্রণোদনা পায়। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ভারী যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী একটি কোম্পানি এমন একটি দেশে তার উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করে যেখানে লোহার সর্বোত্তম সরবরাহ রয়েছে এবং স্থানীয় শ্রমবাজার সস্তা এবং যথেষ্ট দক্ষ। এমনকি করের হার নীতি এবং অন্যান্য প্রণোদনা সংস্থাকেও অনেকাংশে উপকৃত করে অফশোরিং। এছাড়াও আরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অফশোরিংয়ের বিশেষ কিছু প্রভাব লক্ষ করা যায়। অর্থনৈতিক গবেষণার আলোকে, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, ট্যাক্স হলিডে বা কর-অবকাশের মতো সুবিধাগুলো অফশোরিং থেকে পাওয়া যায়। এমনকি ২৪/৭ সার্ভিস প্রদানেও অবদান রাখে যা দেশীয় বিজনেস ইউনিটে সব সময় সম্ভব হয় না। প্রপার্টি অফশোরিংয়ের ফলে ঋণখেলাপির ঝুঁকিও শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসা যায়। প্রকৃতপক্ষে, অপর কোনো দেশে বাড়ি ক্রয় প্রায়ই স্বতন্ত্র একটি বিনিয়োগ প্রক্রিয়া। ব্যাংকক থেকে বার্লিন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অসংখ্য সম্পত্তির বাজার রয়েছে; অনেকগুলিই বিশ্বব্যাপী ইকুইটি বাজারের সাথে সম্পর্কিত নয়। মার্কিন নাগরিকের ক্ষেত্রে অফশোর প্রপার্টি এমন একটি সম্পদ যা রিপোর্ট করা যায় না। আইআরএস তার সমস্ত করদাতাদের তাদের বিদেশী ব্যাঙ্ক এবং ব্রোকারেজ অ্যাকাউন্ট রিপোর্ট করে। তবুও আন্তর্জাতিক সম্পত্তি ছাড় দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, অন্য দেশে সম্পত্তি বিনিয়োগ একটি আকর্ষণীয় সম্ভাবনা হতে পারে।এতে ভাড়ার মাধ্যমে বিদেশী মুদ্রায় আয় করার সম্ভাবনা থাকে যা আজকের অনিয়ন্ত্রিত বাজারে স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা প্রদান করে; এছাড়াও থাকার জন্য বিকল্প আরেকটি জায়গা থাকা যে কারো জন্যেই বিশেষ সুবিধার হতে পারে। তবে অফশোর সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা এত সহজ নয়, বিশেষ করে যখন আয় এবং এস্টেট পরিকল্পনার উপর করের প্রসঙ্গ আসে। যে দেশে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করা হয় পরিস্থিতিভেদে সেই দেশে বেশ কিছু প্রভাবক কাজ করে। অর্থনৈতিক স্কেলে অফশোরিং: অফশোরিং উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদনের চাহিদা হ্রাস করতে প্রভাব বিস্তার করে। দেশীয় কর্মী/উৎপাদকের সংখ্যা কমতে থাকে কারণ সমগ্র উৎপাদন সুবিধাগুলো বিদেশে অফশোরিং প্রক্রিয়ায় চলে যায়। ফলে তাদের উৎপাদনের মাত্রা বাড়াতে থাকে। সংস্থাগুলো প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে তারা আরও বেশি কর্মী নিয়োগ করে। এবং অফশোরিং ফার্মগুলো যখন বৃহত্তর নিয়োগের দিকে পরিচালিত হয়, দেশীয় শিল্পে শ্রমের যোগান তখন কমতে থাকে বিধায় মার্কেটে প্রতিযোগী হ্রাস পায়। ফলে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য যে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি একটি ফার্ম তার পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধিকে কাজে লাগায়, তবে প্রায়শই দেশীয় ও অফশোর উভয় কর্মসংস্থানই বৃদ্ধি পাবে. কিন্তু এই পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে দেশীয় কর্মসংস্থানের উপর অফশোরিংয়ের প্রভাব সম্পর্কে খুব কমই আলোকপাত করা সম্ভব হয়। অফশোরিংয়ের মাধ্যমে যেভাবে কর ফাঁকি দেয়া হয়: ১. অফশোর এন্টারপ্রাইজ মধ্যস্থতাকারীদের মূল ক্ষেত্র হল বিদেশে বাণিজ্য কার্যক্রম। রপ্তানির সময় অফশোর কোম্পানি রপ্তানিকৃত পণ্যগুলোকে সর্বনিম্ন মূল্যে ক্রয় করে এবং পরবর্তীতে এই পণ্যগুলো বিশ্বমূল্যের অধীনেই ট্যাক্স দ্বারা মূল্যায়ন না করে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পরিদর্শনের অধীনে না রেখে চূড়ান্ত ক্রেতার কাছে পুনরায় বিক্রয় করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, অফশোর কোম্পানি ১০০ ডলারে পণ্য প্রস্তুতকারকের কাছ থেকে ক্রয় করেছে। রাশিয়ায় এই পণ্য ২০০ ডলারে বিক্রয় করা যেতে পারে। ১৯৯ ডলার মূল্যে এটি আমদানি করতে হলে, রাশিয়ান এন্টারপ্রাইজ শুধুমাত্র বাকি ১ ডলার থেকে প্রফিট ট্যাক্স প্রদান করবে যা খুবই লাভজনক। ২. অফশোর কোম্পানি ট্রেড মার্ক নিবন্ধন করতে পারে। এছাড়াও লাইসেন্স চুক্তির ভিত্তিতে অফশোর কোম্পানি বিনিয়োগকারীকে নির্দিষ্ট অর্থপ্রদানের ভিত্তিতে এটি ব্যবহার করার অধিকার দেয়। এইভাবে রয়্যালটি (একটি ট্রেড মার্ক ব্যবহারের অধিকারের জন্য একটি অর্থপ্রদান সুবিধা) শুধুমাত্র ট্যাক্স হ্রাস করে প্রফিট বৃদ্ধি করে না, বরং বিদেশে মুদ্রা স্থানান্তর করার একটি আইনি সুযোগও প্রদান করে। ৩. নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পে যাওয়ার পথে অফশোর কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক মূলধন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত, কর ছাড়াই এই ধরনের কোম্পানিতে মূলধন জমা করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, অফশোর কোম্পানির মালিকানার পরিচয় গোপন রেখে নতুন প্রকল্পটি পূর্বের কোনো প্রকল্প বা বিনিয়োগের সাথে সংযুক্ত না করে প্রদান করা সম্ভব। তৃতীয়ত, অফশোর ফিন্যান্সিয়াল সেন্টারের মতো বিনিয়োগের আর কোনো এনটিটি এতোটা সংবেদনশীল নয়। ৪. অফশোর বীমা কোম্পানী দেশ থেকে কার্যত কোনো কর প্রদান না করে সম্পদ রপ্তানি করার অনুমতি দেয়। এক্ষেত্রে সাধারণত মূলধন-ঝুঁকি মোকাবেলার প্রয়োজন হয় না। প্যান্ডোরা পেপারসে অফশোর ইস্যু: প্রাপ্ত প্রায় ১২ মিলিয়ন সংখ্যক ডকুমেন্টের পর্যালোচনা অনুসারে শত শত বিশ্ব নেতা, শক্তিশালী রাজনীতিবিদ, বিলিয়নেয়ার, সেলিব্রিটি, ধর্মীয় নেতা এবং মাদক ব্যবসায়ীরা পেন্ট হাউজ, একচেটিয়া সমুদ্র সৈকত সম্পত্তি, ইয়ট এবং অন্যান্য সম্পদে তাদের বিনিয়োগ লুকিয়ে রেখেছেন বিশ্বজুড়ে অবস্থিত ১৪ টি সংস্থা থেকে। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১১৭টি দেশের ১৫০টি গণমাধ্যমের ৬০০ সাংবাদিক জড়িত। এটিকে "প্যান্ডোরা পেপারস" হিসাবে ডাকা হচ্ছে। এই অনুসন্ধানগুলি অভিজাত এবং দুর্নীতিবাজদের পূর্বে লুকানো লেনদেন এবং কীভাবে তারা ট্রিলিয়ন ডলারের সমষ্টিগতভাবে সম্পদ রক্ষা করতে অফশোর অ্যাকাউন্টগুলি ব্যবহার করে আসছে তার উপর আলোকপাত করেছে। গোপন অ্যাকাউন্টের সুবিধাভোগী হিসাবে চিহ্নিত ৩৩০ টিরও বেশি বর্তমান এবং প্রাক্তন রাজনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছে জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, প্রাক্তন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিস, কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি উহুরু কেনিয়াত্তা, ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি গুইলারমো লাসো এবং উভয়ের প্রাক্তন সহযোগীরা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রতিবেদনে বলা বিলিয়নেয়ারদের মধ্যে রয়েছে তুর্কি নির্মাণ মোগল এরমান ইলিকাক এবং রবার্ট টি. ব্রকম্যান, সফটওয়্যার নির্মাতা রেনল্ডস অ্যান্ড রেনল্ডসের প্রাক্তন সিইও এমনকি ভারতের ক্রিকেট সুপারস্টার শচীন টেন্ডুলকার, পপ মিউজিক ডিভা শাকিরা, সুপার মডেল ক্লডিয়া শিফার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ট্যাক্স এড়াতে এবং অন্যান্য কারণে সম্পদ গোপন করার জন্য অনেক অ্যাকাউন্ট ডিজাইন করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বব্যাপী কর ফাঁকি বৈশ্বিক বৈষম্যকে ইন্ধন দেয়। পাল্টা ব্যবস্থাগুলি এখন আরও প্রসারিত করা দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদগণ। অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল, দাতব্য সংস্থাগুলির একটি ব্রিটিশ কনসোর্টিয়াম নির্লজ্জ বাস্তবতাকে প্রকাশ করার জন্য প্যান্ডোরা পেপারগুলিকে সাধুবাদ জানিয়েছে যা বৃহত্তর কল্যাণের জন্য প্রোগ্রাম এবং প্রকল্পগুলির অর্থায়নে ব্যবহার করা যেতে পারে। তথ্যসূত্র:
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |