রিফাহ তাসনিয়া পূর্বিতামাইক্রোফাইন্যান্স বা ক্ষুদ্রঋণ এমন এক আর্থিক সেবা, যা দ্বারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হয়। সাধারণত এই ঋণ প্রদান করা হয় নিম্ন আয়ের মানুষ ও বেকারদের আত্মকর্মসংস্থান তৈরির উদ্দেশ্যে। ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণে অপারগ দরিদ্র অসহায়ের সেবায় এগিয়ে আসে বিভিন্ন এমএফআই (MFI) বা মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশন গুলো। অন্তত তাই কাম্য। এবার আসি কেন ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক সংগঠন নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের ঋণ দানে উৎসাহিত হয় না। সাধারণত প্রতিটি ব্যাংকেরই লেন্ডিং পলিসি থাকে, যেখান থেকে অর্থ ফেরত পাবার সম্ভাবনা কম সেখানে তারা লোন দিতে উৎসাহ বোধ করে না। অত্যন্ত দরিদ্র ও জমিহীন মানুষের জামানত হিসেবে সুনির্দিষ্ট সম্পদ বা উৎস থাকে না। এর ফলে উদ্যোগ গ্রহণের মত অর্থ ঋণ দেবার ঝুঁকি ব্যাংকগুলো নিতে চায় না। "দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে" আবর্তিত এই জনগোষ্ঠী পিছিয়েই থাকে। এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে মেইনস্ট্রিমে আনতেই ক্ষুদ্র ঋণ সংগঠনগুলো কাজ করে থাকে। এই সংগঠন নন প্রফিট বা অলাভজনক হতে পারে, আবার ফর প্রফিট বা লাভজনকও হতে পারে। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, জামানত ছাড়াই যদি ঋণ প্রদান করে তাহলে এই সংস্থাগুলোর অর্থ ফেরত পাবার নিশ্চয়তা কোথায়? এখানে এমএফআই গুলো পারম্পরিক সংগঠনসমূহ থেকে ভিন্নভাবে কাজ করে। "এলিজিবিলিটি" পলিসি বাদ দিয়ে তারা পুরোপুরি "হিউম্যান অ্যান্ড সোশ্যাল" পলিসি অনুসরণ করে। সেটা কেমন? ঋণগ্রহীতার উপযুক্ততা নির্ধারণের জন্য একটা কমিটি থাকে, যারা পুরোপুরি পর্যালোচনা করে ব্যক্তির ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা, উদ্যম, সততা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। তারপরও ভালো ঋণগ্রহীতার বেশে খারাপ ঋণগ্রহীতার ঝুঁকি রয়েই যায়। সেটা মোকাবিলা করতে সংগঠনগুলো ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে তোলে। যেকোনো উদ্যোগে ঋণগ্রহীতাকে শক্তিশালী টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বাজেট ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে সবরকম সহযোগিতা করে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করা হয় ব্যক্তির পরিবর্তে একটি গ্রুপকে। যেমন, গ্রামীণ ব্যাংক ৫ জনের একটি দল করে ঋণ প্রদান করে। তখন প্রদত্ত সমস্ত অর্থের দায়ভার ওই সলিডারিটি গ্রুপের। এভাবে ঋণগ্রহীতার জবাবদিহিতা বজায় থাকে, নিজের দল ও ঋণদাতা সংস্থার নিকট। তবে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে যতটা সুন্দর এই থিওরি, বাস্তবে তার এক ভাগও সঠিকভাবে কার্যকর হয় না। সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের ডেভিড রুডমেন উনার সাম্প্রতিক বইয়ে উল্লেখ করেছেন: “সবচেয়ে নির্ভুল বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের গড় ভূমিকা শূন্য।” সত্যিকার অর্থে যেটা দেখা যায় তা হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ আসলে ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য কমায় না, বরং আরও বাড়ায়। এর মূল কারণ আসলে খুব সহজ। প্রথমত, ঋণগ্রহীতারা বেশিরভাগই হয় নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন। তারা এই ঋণের অর্থ অনেক সময়ই মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করে। ফলে ঐ অর্থ থেকে আসলে অর্থসৃষ্টি হয় না এবং তারা বরং ঋণের চাপে পিষ্ট হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এসব উদ্যোক্তাদের পণ্যের বাজার থাকে ওই পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীই। সেখানে যা ঘটে তা হলো, হয় ওই পণ্যের চাহিদা অনেক কম, অথবা তার মত বিকল্প পণ্য ইতোমধ্যেই বাজারে আছে। তখন অনেক সময় উদ্যোগ গ্রহণ করেও টিকে থাকা সম্ভব হয় না। ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, ঋণগ্রহীতার অবস্থা উন্নতির পরিবর্তে বরং আরো অবনতি ঘটে। ঋণের বোঝা দিনকে দিন বাড়তে থাকে, অথচ তা পরিশোধের সম্ভাবনা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জামানত বিহীন ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা এমএফআই গুলো কাজ করে মূলত তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষা করাই এর লক্ষ্য। এতে বেকারত্ব দূরীভূত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার বেশিরভাগ স্বল্পোন্নত দেশে (বাংলাদেশের মতই!) নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যও ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম ভূমিকা রাখছে নানাভাবে। বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণের মানসিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ইনোভেশন ও স্কিল ডেভেলপমেন্টের মত গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে। সুদখোর মহাজন বা ধনী কৃষকের কাছে হাত পেতে ক্রমেই দরিদ্রতর হবার ভয়ঙ্কর লুপ থেকে বেরিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ করে দেয় ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নের মূলধারায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশের ভারসাম্য উন্নয়ন সম্ভব হয়।
এ সত্ত্বেও লোন-শার্কিং এর অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। বলা যায় প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই মাইক্রো ফাইন্যান্স কর্মসূচি ঋণগ্রহীতাদের স্বনির্ভর করার পরিবর্তে তাদের উপর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে চলে। এরপরও অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লাভজনক ও অলাভজনক এমএফআই গুলো বিশ্বের অনুন্নত দেশে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তার মূল কারণ আসলে, শ্রেণি সংঘাত ব্যতিরেকেই নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে লাভবান হয় ধনী গোষ্ঠীই। পরোক্ষভাবে এটাই প্রতীয়মান করা হয় যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো তার অবহেলিত সম্প্রদায়ের অগ্রগতিতে ও কর্মসংস্থানে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে কারো ভাগ্য পরিবর্তন না হলে আসলে তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা। দরিদ্রের দারিদ্র্যের কারণ সে নিজেই। আর ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে সেই সুদখোর মহাজনের মতই আচরণ করে। এটি আসলে ‘নিও-লিবারেল উন্নয়ন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। কলোনিয়ালিজম; কাঠামোগত সমন্বয়; রাষ্ট্রের ব্যয়-সংকোচন; অর্থনৈতিক সংকট; জমি-দখল, কর ফাঁকি অথবা আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়; ঋণ আসলে দমিয়ে রাখার অত্যন্ত কার্যকরী মাধ্যম। এর অর্থ এই না ক্ষুদ্রঋণ বিলোপ করা প্রয়োজন, দারিদ্র্যের প্রধান কারণ চিহ্নিত করা ছাড়া ক্ষুদ্রঋণের সফলতা সম্ভব হবেনা। দারিদ্র দূরীকরণের কিছু পদ্ধতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ অপেক্ষা বহুগুনে কার্যকর বলে গবেষণায় দেখা গেছে। নামিবিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলে যেখানে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়, সেখানে কোনো শর্ত ছাড়া সরাসরি অর্থ সহায়তা অত্যন্ত কার্যকরী ভাবে দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রেখেছে। দারিদ্রের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্রঋণ প্রধান হাতিয়ার হতে পারেনা। দারিদ্র একটি কাঠামোগত সমস্যা এবং তার সমাধান কাঠামোগত ভাবেই করতে হবে। শুরু করতে হবে বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ এর মতো সংস্থাগুলোর গণতন্ত্রায়ন এর মাধ্যমে। মূলধন পাচার বন্ধ করা, বাণিজ্য চুক্তি গুলোর মাঝে সাম্যতা, শ্রম-অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই কাঠামোগত সংশোধন করতে হবে। দারিদ্র দূর করতে হলে যে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্র এবং ধনী ব্যক্তিদের ত্যাগ স্বীকার করতেই এর সন্দেহ নেই। এর কোনোরূপ বিকল্পও নেই। আর ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তাদের এতে খুশি হওয়ার কথা নয়। Author
5 Comments
JUMMAN KHAN
6/30/2022 06:51:38 pm
I like your article. Thank you so much.
Reply
OBHI AHAMED ANIK
2/6/2023 05:38:07 pm
like it
Reply
MD FAHIM
2/27/2023 09:21:21 am
এই অনুচ্ছেদে দারিদ্র বিমোচনের জন্য অপ্রিয় সত্য কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে।
Reply
AHMED NAFEES HASSAN
10/31/2023 01:34:19 am
Informative!!!! its a good read indeed 🙏
Reply
Md Sariful Islam
10/31/2023 07:35:37 am
I am a development worker working in a development sector buti am some how confused that is microcradit can develop our society or reduce extrem proverty?
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |