শেখ রাফি আহমেদ আশির দশকে রিগ্যান রেভলিউশন অথবা শিকাগো বয়সদের ব্যবস্থাপত্র মেনে নব্য উদারনীতির যাত্রা শুরু হয়। শুরু থেকেই নব্য উদারনীতির দামামা বাজানো অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে ডানপন্থী লিবারটারিয়ান রাজনীতিবিদ সবার একনিষ্ঠ দাবী ছিল, ব্যক্তি জীবন আর বাজার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কোন ধরনের হস্তক্ষেপ থাকতে পারবে না। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের মুনাফা, ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ ইত্যাদির উপর কর হ্রাস করতে হবে। সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মুক্ত বিহঙ্গের মত ছেড়ে দিতে হবে। আর বাজারব্যবস্থাকে এসকল সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে পারলে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে বাজারে সাম্যাবস্থা নিশ্চিত হবে। তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, এই পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যে কেউ ব্যবসা করতে পারবে। নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। আর এই বাজার ব্যবস্থার অদৃশ্য হাতের বদৌলতে হাজার হাজার মানুষের বেকারত্ব দূর হবে। নিজ বুদ্ধিমত্তা আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে যে কেউ বিত্তশালী হয়ে উঠতে পারবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র থেকে মুক্তি পাবে। গড়ে উঠবে স্বপ্নালু এক পৃথিবী। কিন্তু আদতে তার সিকিভাগও সত্য হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে, নব্য উদারনীতিবাদের পুরো ধারণাটি প্রত্যক্ষভাবে আপনাকে বাস্তবতা থেকে এলিয়েনেট করে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে লাভবান করার নীল নকশা মাত্র। কেন এমন কথা বলছি? একটু পিছনে ফিরে দেখা দরকার। আগেই বলেছি যে, নব্য উদারনীতিবাদের পুরো ধারণাটিই মূলত দাঁড়িয়ে আছে "সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত একটি স্বাধীন বাজার ব্যবস্থা" এর উপর। অর্থাৎ, সরকার যদি বাজারে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ না করে তাহলে বাজার প্রতিযোগিতামূলক হবে আর তার অদৃশ্য হাত দিয়ে জনসাধারণের সকল অভাব, দুর্দশা দূর করবে। শুভংকরের ফাঁকিটা এখানেই। কারণ বাজারের পক্ষে স্বতঃস্ফুর্তভাবে কোন দিন সুষ্ঠু ও স্বাধীন হওয়া অসম্ভব। এটা পদ্ধতিগতভাবেই সম্ভব নয়। কেন? এক কথায় বলতে গেলে, এর কারণ মানুষের ইনিশিয়াল এন্ডাউমেন্ট অফ রিসোর্স সমান না। অর্থনীতির ভাষায় ইনিশিয়াল এন্ডাউমেন্ট বলতে কোন ব্যবসা পরিকল্পনার সূচনাকালে আপনার কাছে যেই পুঁজি থাকে সেটাকে বুঝায়। এই পুঁজি অনেক ধরনের হয়। সেটা হতে পারে আপনার সামাজিক পুঁজি, রাজনৈতিক পুঁজি, আপনার অর্থনৈতিক পুঁজি। আপনার পুঁজি যত বেশি আপনি বাজারে তত বেশি সুবিধা নিতে পারবেন। খেলাটা এখানেই। অর্থনৈতিক পুঁজি আপনার অর্থনৈতিক পুঁজি যদি বেশি হয়, তাহলে আপনি উৎপাদন খরচের চাইতেও কম দামে বাজারে পণ্য বিক্রয় করতে পারবেন। বছরের পর বছর আমাজনের মত ক্ষতিতে পণ্য বিক্রি করবেন। এতে করে, আপনি ইফেক্টিভলি একটা লসের মার্কেট তৈরি করছেন, যেখানে সবাইকে নিজের মার্জিনাল কস্টের চাইতে কম দামে পণ্য বিক্রয় করতে হয়। কিন্তু সবার তো আপনার মত এত টাকা নেই, নেই বিলিয়ন ডলার পুঁজির বিনিয়োগকারী। সুতরাং আপনার যত প্রতিযোগী ছিল, তারা শুধুমাত্র আপনার চাইতে কম পুঁজি থাকার কারণে, এই বাজারে আর টিকে থাকতে পারবে না, বাজার থেকে ঝড়ে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, আমাজন একবার ডায়াপার ডট কম নামে একটি ওয়েবসাইট কিনে নিতে চেয়েছিল। ডায়াপার ডট কম তাতে অস্বীকৃতি জানালে, আমাজন খুব সম্ভবত তার যাবতীয় ডায়াপারে দুই মাস ডিস্কাউন্ট দিয়েছিল। আর এতে করেই শেষ পর্যন্ত ডায়াপার ডটকম হার মানতে বাধ্য হয়। ঠিক এই কারণেই লক্ষ্য করে দেখবেন, কোন একটি নির্দিষ্ট পণ্যের বাজারে কখনোই দীর্ঘমেয়াদে দুই-তিনটির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে না। অর্থাৎ, সব পণ্যের বাজারই দিন শেষে একচেটিয়া বাজার অথবা, অলিগোপলিতে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে অনলাইন মার্কেটপ্লেসের ক্ষেত্রে আমাজন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে ফেইসবুক, তামাকজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো আর ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু বাজার একচেটিয়া বা অলিগোপলি হলে সমস্যা কোথায়? অনেক সমস্যা আছে। এই একচেটিয়া বাজারে উৎপাদনকারীর কোন প্রতিযোগিতা না থাকায় তিনি যেমন নিজের ইচ্ছামত মূল্য নির্ধারণ করতে পারেন, আবার একই ভাবে ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীভেদে, এমনকি পরিমাণভেদেও সুবিধামতো মূল্য নির্ধারণ করতে পারেন। এই মনোপলির একটা উদাহরণ হতে পারে, বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আপনার জরুরি প্রয়োজনের সময় আপনি কখনো অন্য হাসপাতালের খরচ কম না বেশি সেটা চিন্তাও করেন না। অর্থাৎ সেইসময় হাসপাতালটি একজন একচেটিয়া উৎপাদকের ভূমিকা পালন করে এবং নিজের ইচ্ছামত আপনাকে স্বাস্থ্য সেবার জন্য বড় অঙ্কের বিল পরিশোধে বাধ্য করে। অনুরূপভাবে, অলিগোপলি বাজারও এক প্রকার একচেটিয়া বাজারের মতই কাজ করে। এক্ষেত্রে বাজারে বিদ্যমান দুই-তিনটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা না করে কারটেল গঠন করে। তারা একে অপরের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য, পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ ইত্যাদি নির্ধারণ করে। এর সবচাইতে উৎকৃষ্ট উদাহরণঃ ওপেক বা অরগানাইজেশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ। এর সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন ইত্যাদি রাষ্ট্র। এই কার্টেল গঠনের মাধ্যমেই এরা বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারের উপর গভীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এতে করে সৌদি আরামকোর মত উৎপাদনকারীরা বিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করছে, কিন্তু আপনার আমার মত সাধারণ ভোক্তারা জ্বালানীর মূল্য পরিশোধ করতে হয়রান হচ্ছি। এখানেই শেষ নয়। অর্থনৈতিক পুঁজির একটা পরোক্ষ কিন্তু একইরকম শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। দিনশেষে ব্যবসা করতে হলে, বাজারে টিকে থাকতে হলে আপনার ঘটে ঘিলু থাকতে হবে, শিক্ষা থাকতে হবে। নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের যেকোন সন্তানের এই তথাকথিত প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার সম্ভাব্যতা একজন উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তানের চেয়ে অনেকাংশেই কম। এজন্যে লক্ষ্য করে দেখবেন, ব্যক্তি জীবনের সফল বিজনেস ক্যারিয়ার আইকন বা মোটিভেশনাল স্পিকাররা অধিকাংশই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। হিরো আলম চাইলেও সেটা হতে পারবেন না। রাজনৈতিক পুঁজি আপনার অর্থনৈতিক পুঁজি বেশি হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনার রাজনৈতিক পুঁজিও বেশি হবে। আপনি খুব সহজেই বিভিন্ন অঞ্চলের সেনেটর, কাউন্সিলর, গভর্নরদের নির্বাচনে আর্থিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে অথবা মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে তাদের আপনজন হয়ে উঠতে পারবেন। এই ঘুষ তথা অনুদানের বিনিময়ে খেলাপী ঋণমুক্তি, কর ফাঁকি, শ্রমিক শোষণ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন ইত্যাদি সকল অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে পারেন। আবার নিজের পছন্দ অনুযায়ী ফিস্ক্যাল আর মনেটারি পলিসিও গড়ে তুলতে পারেন। মাঝে মাঝে আপনি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের অনুদানের খোলসে উপঢৌকন পাঠাতে পারেন। তারা তখন আপনার হয়ে, কেন সরকারের এই অর্থবছরে কর হ্রাস করা উচিত বা কেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা উচিত- এই বিষয়ে একটি পিয়ার রিভিউড গবেষণা পত্র ছাপিয়ে দিবে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন ফেডেরাল রিজার্ভের চেয়ারম্যান এলান গ্রীনস্প্যান অথবা ট্রেজারি সেক্রেটারি ল্যারি সামার্স এর কথা বলা যায়। তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপত্রই ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মুখ্যত দায়ী। তারা বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মদদে অসংখ্য সতর্কতার বাণী সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রীটের ডেরিভেটিভের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে দেন নি। বরং এর বিপরীতে সরকারকে উপদেশ দিয়েছেন। তাদের এধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপত্রই ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মুখ্যত দায়ী। এ বিষয়ে আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও বলা দরকার। আমার পরিচিত এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যবসা খারাপ চলছে। কারণ কোন এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা ঢাকার তার এলাকায় একটি কোম্পানির লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের ডিলারশিপ নিয়েছেন। এখন তিনি তার রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে সেই এলাকায় অন্য কোন ডিলারের গাড়ি ঢুকতে দেন। ফলে ঐ এলাকায় সবাইকে তার কাছ থেকেই মাল কিনতে হয় আর তিনি নিজের ইচ্ছামত দাম দিয়ে সেই মাল বিক্রি করেন। আর এদিকে বাকি সব ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। আঞ্চলিক থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এধরনের হাজার হাজার উদাহরণ পাওয়া যাবে। সামাজিক পুঁজি এখানে একটু বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনা করা দরকার। আপনি যদি একজন ঐতিহাসিকভাবে শোষিত জনগোষ্ঠীর সদস্য হন (যেমনঃ কৃষ্ণাঙ্গ) তাহলে একজন সাদা চামড়ার তুলনামূলক কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিও আপনার চাইতে ব্যবসায় অধিক লাভবান হবে, যদিও তার উত্তরসূরীরা সুনিপুণ চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে এই সামাজিক পুঁজি অর্জন করেছেন। আপনি ব্যবসা করতে যাবেন, আপনাকে লাইসেন্স পাওয়ার জন্যে একশটা পদ্ধতিগত ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাইতে হবে। কিন্তু সেই শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি শুধুমাত্র চামড়ার রঙের কারনে আপনার উপরে অগ্রাধিকার পাবে। এটার সবচাইতে উত্তম উদাহরণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মারিজুয়ানা শিল্প। বছরের পর বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা নন-ভায়োলেন্ট ড্রাগ অফেন্সে্র কারণে প্রাইভেট প্রিজনের গিনিপিগ হয়েছেন। যখন বিভিন্ন স্টেইটে মারিজুয়ান বৈধ ঘোষণা করা হল, সবাই হাফ ছেড়ে বাচল। এবার বোধ হয় ব্ল্যাক-আমেরিকানদের সুদিন ফিরবে। (সেটা আগে কবে ছিল, খোদা জানে) কিন্তু দেখা গেল, সেখানেও ৮১% ব্যবসায়ী সাদা চামড়ার আর মাত্র ৪% কৃষ্ণাঙ্গ। চামড়ার রঙ একটু গাঢ় হলেই লাইসেন্স পেতে কষ্ট হচ্ছে। এখানে আবার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক পুঁজিরও খেলা আছে। লিগ্যাল মারিজুয়ানার ব্যবসায় যাতে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারে এজন্যে কাউকে ১ একরের বেশি জমিতে মারিজুয়ানা চাষ করতে দেওয়া হত না। কিন্তু অতি বৃহৎ কর্পোরেশন এসে তাদের লবিয়িস্ট আর অঢেল অর্থ দিয়ে সেই আইনটিকে নাল এন্ড ভয়েড করে দিল। আর এখন সেটার ফল ভোগ করছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। উপরের যাবতীয় কথার সারমর্ম একটাই। বাজার ব্যবস্থা কোনদিনই একই সাথে স্বাধীন ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব না। বিনা হস্তক্ষেপে সকল বাজারেই মগের মুল্লুক ওরফে ওলিগোপলি বা মনোপলি প্রতিষ্ঠিত হবে। যার অর্থ যত বেশি, সেই র্যুল করবে আর অদৃশ্য হাত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর গালে চড় মারা ছাড়া অন্য কোন কাজে আসবে না। এর সল্যুশনও খুব সহজ। কর্মক্ষেত্রের গণতন্ত্রায়ন, এন্টি-ট্রাস্ট ল, ক্যাম্পেইন ফাইনান্স রিফর্ম ইত্যাদি ইত্যাদি। সবই প্রগতিশীলদের গুরু বার্নি সান্ডার্স বলে গিয়েছিলেন। বুড়ো ধামড়া ব্যুমাররা শুধু বুঝল না। একটা চুটকি বলে শেষ করি। সাম্প্রতিক সময়ে সোয়ামী নামক এক শ্বেতাঙ্গ বুড়ো শুধুমাত্র ক্যানাবিসের ব্যবসা করার জন্য খয়েরী সাজার ভং ধরা শুরু করেছেন। এটা খুব সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের সবচাইতে সিগ্নিফিক্যান্ট পোস্ট কলোনিয়াল রিভেঞ্জ।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |