ওমর রাদ চৌধুরী
ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট কতৃক ‘রুল অফ ল’ ইন্ডেক্সে ডেনমার্ক বিশ্বের এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে (http://data.worldjusticeproject.org/#table)। জেণ্ডার সমতা ও অধিকারের অন্যান্য সূচকেও দেশটি শীর্ষস্থানে রয়েছে। তবুও গত বছর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায় ডেনমার্কে ‘ব্যাপক যৌন সহিংসতা’ রয়েছে। মার্চ ১১,২০১৯ এর বিবিসির একটি রিপোর্টে বলছে: ড্যানিশ আইন মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বছরে প্রায় ৫১০০ নারী ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার স্বীকার হন, অন্যদিকে সাউদার্ন ডেনমার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংখ্যাটি ২৪০০০ এর বেশি যা একটি অপেক্ষাকৃত কম জনসংখ্যার দেশের(৫.৮ মিলিয়ন) জন্য একটি বিরাট সংখ্যা। ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ’ নামে দক্ষিণ আফ্রিকা ভিত্তিক একটি বিশ্ব বাজার গবেষণা সংস্থা তাদের ২০১৯ সালের গ্লোবাল ওয়েলথ মাইগ্রেশন রিভিউতে অস্ট্রেলিয়াকে নারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ দেশ বলেছে। অস্ট্রেলিয়াও ডেনমার্কের মতো জেণ্ডার ক্ষমতা সম্পর্কিত সূচকগুলোতে ভাল করছে। অস্ট্রেলিয়ান স্ট্যাটিস্টিকস ব্যুরো (এবিএস) দ্বারা পরিচালিত ব্যক্তিগত সুরক্ষা জরিপ ২০১৬ অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন যৌন সহিংসতার (১৮% বা ১.৭ মিলিয়ন) স্বীকার, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৭% (১.৬ মিলিয়ন) এবং যৌন হুমকির স্বীকার হয়েছেন ৪% (৩৩৯,৯০০) । যুক্তরাষ্ট্রকে ইচ্ছাকৃতভাবেই এই আলোচনা থেকে বাদ রাখা হয়েছে কেননা উপরে বর্ণিত সূচকগুলোতে অস্ট্রেলিয়া ও ডেনমার্কের তুলনায় দেশটির অবস্থা যথেষ্ট হতাশাজনক। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের শিরোমণিদের ধর্ষণের পরিসংখ্যান চিত্র মোটেই সুখকর নয়। ২০১৮ সালের ইউনিফর্ম ক্রাইম রিপোর্ট অনুসারে বলা হয় ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ধর্ষণের রিপোর্ট এসেছে ১২৭,২৫৮ টি (https://ucr.fbi.gov/crime-in-the-u.s/2018/crime-in-the-u.s.-2018/topic-pages/tables/table-25) । ২০১৬ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম ভিকটিমাইজেশন সার্ভে (এনসিভিএস) দ্বারা অনুমান করা হয়েছে, ২০১৫ সালে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের ৪৩১,৮৪০ টি ঘটনা ঘটেছে, যা পুলিশকে জানানো হয়নি (https://www.bjs.gov/index.cfm?ty=pbdetail&iid=5804) । এছাড়াও, ‘মি টু’ আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে যৌন নির্যাতনের বহু ভয়ংকর ঘটনা আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। এই তথ্যগুলো থেকে আমাদের এমনটা ভাবা উচিৎ নয় যে, দক্ষিণ এশিয়া বা মধ্য প্রাচ্য এবং নর্ডিক দেশগুলির অথবা লম্বা দাগে বলতে গেলে বৈশ্বিক উত্তর (যেখানে আইনের শাসন বহুলাংশে বিদ্যমান) এবং বৈশ্বিক দক্ষিণ (যেখানে আইনের শাসন দুর্বল) এর পরিস্থিতির মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। এই তথ্যগুলো দুটি বিষয়কে ইঙ্গিত করেঃ ১) জেণ্ডার সূচকগুলোতে ভাল অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যেও পুরুষতন্ত্রের প্রভাব এখনো বিরাজ করে ২) আইনের শাসন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারলেও এটি নারীদের প্রতি যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরোধ হিসাবে কাজ করে না, যেমনটি সাধারণত বিশ্বাস করা হয়। তারপরও এই যুক্তি দেওয়া একেবারেই ভুল হবে যে আইনের শাসনের সাথে নারীর সুরক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। অনাচার এবং আইনের শাসন এই দুটি পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্যই দ্বিতীয়টি নারীদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। তবে এটিও সত্য যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, নারীদের জন্য বিশেষায়িত নীতি গ্রহণ, সমান সুযোগের ব্যবস্থা, জেণ্ডার সমতার আদর্শপন্থী পাঠ্যক্রম প্রণয়ন—এগুলির কোনটিই পুরোপুরি পুরুষতন্ত্রকে বিলুপ্ত করতে এবং জেণ্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়। বেশিরভাগ উদারপন্থী এ ধরণের যুক্তির প্রতি সন্দিহান হতে পারেন। কারণ পুরুষতন্ত্রের বিনাশ করতে, তাঁরা যেই মুক্তবাজার প্রক্রিয়া ও সীমিত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অপূর্ব সমাহার তথা কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখেছেন, উপরের বক্তব্য তার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। দুর্ভাগ্যবশত, প্রকৃত অবস্থা তাদের ধারণাকে সমর্থন করে না। যদিও তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করতে পারেন পুরুষতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের কোন সম্পর্ক নেই এবং দিবাস্বপ্ন দেখতে পারেন যে পুঁজিবাদ-কে মোকাবেলা না করেও পুরুষতন্ত্রকে বিলুপ্ত করা সম্ভব। মরগানের গবেষণাকর্মের উপর ভিত্তি করে এঙ্গেলস ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং পুরুষতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্কের একটি অসাধারণ অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা অনুসারে যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার বিকাশের জন্য উত্তরাধিকার রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তে পরিণত হয়েছিল সেহেতু কৃষি বিপ্লব পরবর্তী মানবসমাজ মাতৃত্ববাদ থেকে সরে এসে পুরুষতান্ত্রিকতায় ধাবিত হয়েছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে শুরু করে, দাস সমাজ, সামন্ততন্ত্র হয়ে বর্তমানের পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি তার রূপ বদলালেও মানব সমাজের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোয় তার নির্ণায়ক ভূমিকাটির পরিবর্তন হয়নি। এবং সেজন্যই এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে যতদিন পর্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিদ্যমান থাকবে, ততদিন একে ঘিরে যে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে সেটিও পুরুষতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখবে। এই মিথোজীবী ব্যবস্থাটি আবার পুঁজিবাদের দুটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে শক্তিশালী হয়: একটি হচ্ছে পণ্যায়ন (commodification) অন্যটি পণ্য পূজা (commodity fetishism)। নারীকে কেবল যে ভোগ্যপণ্য করা হয়েছে তাই নয়, তাকে ভোক্তার আরাধ্য পূজনীয় পণ্য হিসেবে বিপণন করা হয়েছে। ফলে নারীর স্বাতন্ত্র্যকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে এবং পুরুষের দ্বারা নারীর উপর সব ধরনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ক্ষমতা চর্চার বৈধতা দেওয়া হয়েছে; এগুলি সবই নারীর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক বৈষম্য এবং যৌন সহিংসতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
এটি বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ যে আইনের শাসন হল রাষ্ট্র ও পুঁজির মধ্যেকার ঐক্যের ফল। পুঁজি যতটা দক্ষ, রাষ্ট্রও সেই পুঁজির স্বার্থ রক্ষায় তত বেশি নিবেদিত। বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশিরভাগ দেশে পুঁজিবাদ এখনো ততটা পরিণত নয়, রাষ্ট্রও অনুরূপভাবে আইনের শাসন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সহজাতভাবে অক্ষম। এর প্রাথমিক কারণ হল সেসব দেশে বিদ্যমান অপরিপক্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আইনের শাসনের অভাবে পুঁজিবাদীরা সহজে মুনাফা করে থাকে। এটিকে সম্ভবত পুঁজির প্রাথমিক আরোহণের (Primitive Accumulation of Capital) সাথে তুলনা করা যেতে পারে যা আধুনিক পুঁজিবাদের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এই পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত কারণ অবশ্যই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণে বিবেচনা করতে হবে। যারা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে ক) পুঁজিবাদ থেকে পৃথক একটি ব্যবস্থা হিসাবে পুরুষতন্ত্রকে বিবেচনা করলে এই আন্দোলনের পথ নির্ধারণে ভুল হবে এবং, খ) বৈশ্বিক দক্ষিণে (যেমন বাংলাদেশ) পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে লড়াই সেটি বৈশ্বিক উত্তরের লড়াইয়ের মত একই রকম হতে পারে না, কেননা বৈশ্বিক উত্তরে ও বৈশ্বিক দক্ষিণে পুরুষতন্ত্রের মূল কাঠামো এক হলেও, যেহেতু দুই অঞ্চলে পুঁজির অবস্থা ভিন্ন, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। দ্রষ্টব্য: লেখাটি ইংরেজি ভাষায় অনলাইন জার্নাল Countercurrents এবং সাপ্তাহিক Frontier এ প্রকাশিত হয়েছিল। Frontier এ প্রকাশিত লেখাটির লিঙ্ক: http://bit.ly/FightAgainstPatriarchy ভাষান্তর: সাফা তাসনিম, এসোসিয়েট মেম্বার, ইকোনমিক্স স্টাডি সেন্টার
1 Comment
মোঃ আরিফুল হাসান
3/11/2020 02:58:00 am
এই ব্লগের লেখাগুলোতে সবসময়ই অতি সহজবোধ্যভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিশ্লেষণ থাকে। ধন্যবাদ লেখক ও অনুবাদক কে।
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |