মাসরুর আবদুল্লাহ ও রাফিদ ইশতিয়াক কোভিড-১৯ বা করোনা সংকটে যখন সারাবিশ্ব নাকাল তখনই বিশ্লেষকদের মনে উঁকি দিচ্ছে যে আগামী পৃথিবীর নেতৃত্বভার কি তবে এবার চীনের হাতে যাচ্ছে? করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে হলেও বেশ দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে চীন। সারাবিশ্বের বড় বড় দেশগুলো যখন লকডাউনে আছে, তখন চীন সাফল্যের সাথে লকডাউন উঠিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। যেখানে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি কিংবা সংকট মোকাবেলার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেখানে চীনের সংকট থেকে উত্তরণ এবং আক্রান্ত দেশগুলোকে সাহায্য করা ও বাণিজ্যের তালে তালে পুরো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো কি সেই "সুয়েজ মুহূর্তের" কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, যখন নীরবে নিভৃতে যুক্তরাজ্যের থেকে বিশ্ব নেতৃত্ব হাতে তুলে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ? আসুন দেখি বিশ্ব নেতৃত্বভার কেন চীনের হাতে আসতে পারে তার পেছনে সম্ভাব্য ৮টি কারণ- ১। বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা দীর্ঘ আফগান যুদ্ধের হতাশাজনক ফলাফল, ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়া,প্যারিস চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়া, ব্রেক্সিট ইস্যুতে যুক্তরাজ্যকে সমর্থন করা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে টানাপোড়েন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মিত্রদের সাথে ক্রমান্বয়ে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার খেসারত দিতে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে। করোনা সংকটে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে না পারার ব্যর্থতা, এছাড়া করোনা সংকটে নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য মেডিকেল সরঞ্জাম রপ্তানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, এমনকি জার্মানিতে পাঠানো ২ লক্ষ পিস এন৯৫ মাস্কের চালান ব্যাংকক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জব্দ করা, যাকে মিত্র দেশের বিরুদ্ধে 'আধুনিক যুগের জলদস্যুতা' বলে আখ্যা দিয়েছে জার্মানি- এ সকল পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় সুবিধাধারী হলো চীন। ২। চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন ; জিডিপি (পিপিপি) এর হিসাবে বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতি চীনের। বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ম্যানুফ্যাকচারিং হাব চীনের, সাথে রয়েছে শি জিনপিং এর একচ্ছত্র আধিপত্য এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। চীনের অর্থনীতি এতটাই শক্তিশালী যে সম্প্রতি বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের অর্থনীতিকে তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। এছাড়াও, করোনা সংকটে যখন পুরো পৃথিবীর বাণিজ্য স্থবির তখন চীন করোনা সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন দেশে মেডিকেল সরঞ্জাম এবং অন্যান্য সামগ্রী পৌছে দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক সবলতা রক্ষা করে চলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চীন ২০২০ সালের প্রথম ৩ মাসে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের শুধু মেডিকেল সরঞ্জামই রপ্তানী করেছে। ৩। সামরিক শক্তি গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের মতে, ২০২০ সালে পৃথিবীর তৃতীয় শক্তিশালী সামরিক শক্তি হল চীনের। পারমাণবিক শক্তিধর এই দেশটির রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র-শস্ত্র, বিমান, সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ, বিমানবাহী রণতরী প্রভৃতি। পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম অস্ত্র বিক্রেতা হল চীন। দক্ষিণ চীন সাগর, যেই পথে পৃথিবীর ৩০% বাণিজ্য হয়ে থাকে, সেখানে চীনের ভাসমান নেভাল বেজ রয়েছে। এছাড়াও, আফ্রিকার দেশ জিবুতিতেও চীনের সামরিক ঘাটি রয়েছে, যা মিশরের সুয়েজ খালের কাছাকাছি। ৪। Chinalization/চীনাকরণ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ- যার মাধ্যমে পৃথিবীর একটি বিরাট অংশকে অবকাঠামোগতভাবে উন্নত করে চীনকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাস্টার প্ল্যানের দিকে হাটছে চীন। এছাড়াও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বাণিজ্যিক কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের বাণিজ্যিকীকরণ কৌশল সাজিয়েছে চীন। যেহেতু দিন দিন চীনে উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে, সেহেতু চীন আফ্রিকাসহ পৃথিবীর যে সকল জায়গায় সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায় সেখানে বিনিয়োগ করছে যেমনঃ ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, জিবুতি, মায়ানমার, কম্বোডিয়া প্রভৃতি । দেশ দখল না করেই চীন আফ্রিকার দেশগুলোর অর্থনীতি বিকাশে সাহায্য করছে এবং বিরাট অঙ্কের মুনাফা বাগিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও, ইউরোপ-আমেরিকার মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ক্রয়ের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের সবল উপস্থিতির জানান দিচ্ছে চীন। ৫। বিশাল দক্ষ জনগোষ্ঠী ১৪০ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ২৮ কোটি মানুষ দক্ষ জনশক্তি হিসেবে চীনের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। এছাড়াও প্রায় সাড়ে ৮ কোটি অতি দক্ষ (highly skilled) জনশক্তি রয়েছে চীনের। চীনের যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি রয়েছে তা ইউরোপের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। ৬। উন্নত প্রযুক্তি বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে স্বীকৃত চীনের তৈরি করছে অত্যাধুনিক ৫জি প্রযুক্তি। এছাড়াও পৃথিবীর সেরা সেরা ইলেকট্রনিক্স পণ্য থেকে শুরু করে মেডিকেল সরঞ্জাম প্রায় সব কিছুই চীনে উৎপাদিত হয়। পৃথিবীর অন্যতম সেরা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত প্রযুক্তি রয়েছে চীনের। করোনা সংকটের সময়ে ১০ দিনে বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিয়েছে চীন। ৭। কূটনৈতিক সুসম্পর্ক বিভিন্ন বাণিজ্য ও সামরিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিনিয়তই মিত্র দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে চীন।নিজের প্রতিবেশি দেশ গুলো যেমন- রাশিয়া, পাকিস্তান, মোঙ্গলিয়ার,ইরানের মত দেশগুলোর সাথে চীনের রয়েছে অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক। একমাত্র ভারতের সাথে ভৌগলিক কারণে কিছু রেশারেশি থাকলেও ভারতের সাথে ঠিকই বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে চীন। এছাড়াও নেপাল,ভূটান, শ্রীলংকার মত দেশগুলোতেও চীনের প্রভাব বিদ্যমান। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাথে সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে আগাচ্ছে, সেখানে চীনের কূটনীতি শতভাগ সফলতার মুখ দেখছে। ৮। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্দ্বন্দ্ব করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইইউ এর প্রস্তুতিহীনতা এবং সদস্য দেশগুলোর একে অপরের প্রতি সংকীর্ণ মনোভাব নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে। সংকটের সময়ে ইইউ এর শক্তিশালী সদস্য দেশগুলো যেমন নেদারল্যান্ডস এবং জার্মানির স্বার্থপরের মত আচরণ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে স্পেন। এছাড়াও ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ এই সংগঠনটির একতা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ইইউ এর মত সংগঠিত এবং একতাবদ্ধ সামরিক এবং অর্থনৈতিক সংগঠনের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চীনের বিশ্বনেতৃত্বের ভার গ্রহনের সময়কে ত্বরান্বিত করছে মাত্র। চীনের জন্য নব বিশ্বমোড়ল হয়ে ওঠা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ভারত, তুরস্কের মত উদীয়মান শক্তিধর দেশগুলো কিংবা বিশ্ব নেতৃত্বের খুব কাছাকাছি থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা রাশিয়ার মত দেশগুলো হয়তোবা চীনের একচ্ছত্র আধিপত্যের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে নিকট ভবিষ্যতে ভূরাজনৈতিক উপাখ্যানে নেতৃত্বের পালাবদল পৃথিবী দেখতে যাচ্ছে তা এক প্রকার নিশ্চিত। সময়ই বলে দেবে কে শেষপর্যন্ত বিশ্বমোড়লের সিংহাসন পদানত করে। তথ্যসূত্রঃ ১।https://www.globalfirepower.com/country-military-strength-detail.asp?country_id=china ২।https://www.bbc.com/news/av/world-asia-china-51348297/coronavirus10-days-of-hospital-building-in-60-seconds ৩। https://www.prothomalo.com/international/article/1650303/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E2%80%93%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%80-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%87 ৪।https://www.youtube.com/watch?v=luTPMHC7zHY ৫।https://www.youtube.com/watch?v=X7iKgXSQcuc মাসরুর আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৯৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, যে বিশ্বাস করতে চায় পৃথিবীর সব মানুষ ভালো। রাফিদ ইশতিয়াক একজন গর্বিত বাংলাদেশি, যে রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করতে ভালবাসে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |