ইনজামামুল হক খান আলভীজম্মু ও কাশ্মীরের জন্ম হয়েছিল ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর । হেনরি লরেন্সের পরামর্শে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড হার্ডিঞ্জ কাশ্মীর উপত্যকাকে তাঁদের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সেই ক্ষয় ক্ষতি পুনরুদ্ধার করতে অমৃতসর চুক্তি অনুসারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরকে জম্মুর দোগড়া শাসকদের কাছে বিক্রি করা হয় । তখন থেকে শুরু করে অর্থাৎ ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর মহারাজা দ্বারা শাসিত একটি দেশীয় রাজ্য ছিল । চুক্তি অনুসারে এই রাজ্যের বিস্তার ছিল সিন্ধু নদের পশ্চিম দিক থেকে রাভি নদীর পূর্ব দিক পর্যন্ত এবং আয়তন ছিল প্রায় ৮০৯০০ বর্গ মাইল (২১০০০০ বর্গ কিমি) । পরবর্তী কালে হুনযা,নাগার এবং গিলগিট এই রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হয় । দেশীয় রাজ্য হওয়ার আগে কাশ্মীর পাস্তুন দুরানি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। পরবর্তীকালে রণজিৎ সিংহ এটিকে শিখ সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন । জম্মু ছিল তখনকার শিখ সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্য । ১৮৪৫ সালের শীতকালে ব্রিটিশ এবং শিখদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । ১৮৪৬ সালে সব্রাওন এর যুদ্ধ পর্যন্ত গুলাব সিং নিরপেক্ষ থাকেন, তারপর তিনি একজন মধ্যস্থতাকারী এবং স্যার হেনরি লরেন্স-এর বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। অবশেষে দুটি চুক্তি হয় । প্রথম চুক্তি অনুসারে লাহোরকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, দশ মিলিয়ন টাকা মূল্যের বিপাশা ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী পার্বত্য রাজ্য নানকশাহীর ক্ষতিপূরণের সমতুল্য হিসাবে এবং দ্বিতীয় চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা সাড়ে সাত মিলিয়ন টাকার বিনিময়ে সিন্ধু নদের পূর্বে এবং রাভি নদীর পশ্চিমে অবস্থিত সমস্ত পার্বত্য অঞ্চল গুলাব সিংয়ের কাছ থেকে নিয়ে নেয় । তৎকালীন শিখ সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাপতি লাল সিং, যিনি পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কাশ্মীরের শাসনকর্তা ইমামউদ্দিনকে দোগড়াদের প্রতিরোধ করতে অনুরোধ করেছিলেন যারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্য থেকে শিখদের প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেছিল । ব্রিটিশরা গুলাব সিং এর সহায়তায় কাশ্মীরের শাসনকর্তা ইমামউদ্দিন কে উৎখাত করে এবং কাশ্মীর ও জম্মুর নতুন মহারাজা হিসাবে গুলাব সিং কে নিযুক্ত করে । বর্তমান ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর (যেটি জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখের সমন্বয়ে গঠিত), পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালটিস্তান অঞ্চলদ্বয় এবং চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চলদ্বয় বৃহত্তর কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত। ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট' নামে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান - যে কোন রাষ্ট্রেই যোগ দিতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সাথে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালটিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দেবার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ - যা চলেছিল প্রায় দু'বছর ধরে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়। জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়। কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে, তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে চীন কাশ্মীরের আকসাই-চীন অংশটির নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, আর তার পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন - এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে।দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে, এর পর আরেকটি যুদ্ধবিরতি চু্ক্তি হয় । এর পর ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তির মধ্যে দিয়ে বর্তমানের 'লাইন অব কন্ট্রোল' বা নিয়ন্ত্রণ রেখা চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে - যা নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে চিহ্নিত নয়। ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬৮.৪১ শতাংশ মুসলিম। এটিই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।এখানে বেকারত্বের হার অত্যন্ত উঁচু, তা ছাড়া রাস্তায় বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে। কাশ্মীরে বিদ্রোহী তৎপরতা বড় আকারে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর জেকেএলএফ নামে সংগঠনের উত্থানের মধ্যে দিয়ে। এরপর থেকে সংঘাত চলমান রয়েছে। ভারতের অধিভুক্ত কাশ্মীরে ১৯৪৮ সালে কাশ্মীরি নেতা শেখ আব্দুল্লাহ সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিষয়ে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করেন। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা পায় জম্মু ও কাশ্মীর।৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদ যোগ হয়েছিল ভারত ও কাশ্মীরের নেতাদের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে। বিধানটিতে জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়া হয়, তা ছাড়া পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে কাশ্মীরের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা হয়।১৯৫৬ সালে জম্মু ও কাশ্মীর আলাদা সংবিধান পায় এবং ভারতের অংশ হিসেবে নিজেদের সংজ্ঞায়িত করে। কিন্তু ২০১৯ এ এসে বদলে গেল ৬৯ বছরের ইতিহাস। জম্মু কাশ্মীর নিয়ে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিল মোদী সরকার। তুলে দেওয়া হল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। ‘বিশেষ মর্যাদা’ হারাল জম্মু কাশ্মীর। উপত্যকায় রইল না আলাদা সংবিধান,আলাদা পতাকা।এর পাশাপশি জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ— এই দু’টি আলাদা রাজ্যের প্রস্তাব সংসদে পেশ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ফলে জম্মু-কাশ্মীর যে শুধু বিশেষ মর্যাদা খোয়াল তাই নয়, রাজ্যের স্বীকৃতিও হারানোর পথে। সন্ধেয় রাজ্যসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে এই প্রস্তাব। রাজ্য ভাগের প্রস্তাবের পক্ষে ১২৫টি ভোট পড়েছে। ৬১ জনের ভোট পড়েছে বিক্ষোভে। ৪ আগস্ট পর্যন্ত যে জম্মু-কাশ্মীর ছিল ‘বিশেষ মর্যাদা’প্রাপ্ত রাজ্য, ৫ আগস্ট থেকে সেটাই হয়ে গেল সাধারণ। পটভূমিটা অবশ্য তৈরি হচ্ছিল এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে। অমরনাথ যাত্রী এবং পর্যটকদের কাশ্মীর ছাড়ার নির্দেশ, সমান্তরাল ভাবে দফায় দফায় প্রচুর অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের জেরে নানা জল্পনা ভাসছিল উপত্যকায়। উত্তেজনা বাড়ে ৩ আগস্ট শনিবার রাতে মেহবুবা মুফতির বাড়িতে সর্বদল বৈঠকের পর। ওই বৈঠকের পরই কাশ্মীরের কয়েক জন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। গৃহবন্দি করা হয় রাজ্যের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি-সহ অনেক নেতাকেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল ১৪৪ ধারা জারি এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের ঘোষণা।১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় ৩৭০ ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হলেও সেই মর্যাদা স্থায়ী ছিল না, বরং ছিলো অস্থায়ী সংস্থান। কিন্তু এই ধারারই ৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে এই ‘বিশেষ মর্যাদা’ তুলে নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির ওই ক্ষমতাকে ব্যবহার করেই কাজ হাসিল করল মোদী সরকার। অর্থাৎ নির্দেশনামায় রাষ্ট্রপতি সই করার পরের মুহূর্ত থেকেই রদ হয়ে গেল ৩৭০ ধারা। এই ধারার অধীনেই ৩৫এ ধারায় ভারতীয় ভুখণ্ডে থেকেও ভূস্বর্গের বাসিন্দারা যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, খারিজ হয়ে গেল সেটাও। ৩৭০ ধারাঃ ৩৭০ ধারা বাতিলের ঘোষণার পরেই সংসদে তীব্র প্রতিবাদ করে বিরোধী দলগুলো। জম্মু-কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি ছাড়াও কংগ্রেস, আরজেডি, টিএমসি, ডিএমকে, সিপিএম সাংসদরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ওয়াকআউট করে বিজেপির শরিক দল জেডিইউ। অন্য দিকে সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল বিজেডি, ওয়াইএসআরসিপি, শিব সেনা, টিআরএস, টিডিপির মতো দল। তার সঙ্গে বিরোধী শিবিরের মায়াবতীর বিএসপি এবং অরবিন্দ কেজরীবালের আপ সাংসদরাও এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। ফলে ৩৭০-এর ধাক্কায় সংসদের সমীকরণও উল্টে-পাল্টে গিয়েছে। ভারত সরকার একে কাশ্মীরের উন্নয়নে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলে অ্যাখ্যায়িত করলেও কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৩৭০ ধারা বাতিলের ফলে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ কি হবে তা সময়ই বলে দেবে। তথ্যসূত্রঃ ১/https://dsal.uchicago.edu/reference/gazetteer/pager.html?objectid=DS405.1.I34_V15_101.গিফ ২/http://www.opsi.gov.uk/RevisedStatutes/Acts/ukpga/1947/cukpga_19470030_en_1 ৩/http://egazette.nic.in/WriteReadData/2019/210049.pdf ৪/https://www.anandabazar.com/amp/ ৫/https://www.bbc.com/news/world-asia-india-49234708 ৬/https://www.bbc.com/bengali/news-49262297 ইনজামামুল হক খান আলভী অর্থনীতি বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। ভালোবাসি আমার প্রিয় স্বদেশকে। জানতে চাই পুরো বিশ্বকে,সমৃদ্ধ করতে চাই তথ্যের ভাণ্ডার।
1 Comment
Tanveer iftekhar ifti
4/5/2020 10:59:42 pm
Nice .. ❤️
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |