আনিসুর রহমান স্বাধীনতার ৪৮ বছর। পাওয়া আর না পাওয়ার হিসাব চোকাতে গেলে অনেক কিছুর গলদ চোখে পড়বে। হয়তোবা যতটুকু উন্নয়ন হবার কথা ছিল ততটুকু হয়নি। তবে আশাতত হওয়াও ঠিক হবে না। সাম্প্রতিক সময়ের বিবেচনায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা থেকে সেই কবেই আমরা বেরিয়ে এসেছি। তারপর বাংলাদেশ হেঁটে এসেছে অনেকটা পথ। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ এখন সমীহ জাগানিয়া দেশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক রেমিটেন্স অর্জন কিংবা মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ এখন যেকোন দেশকে টেক্কা দিতে প্রস্তুত। এতসব উন্নয়ন আশা জাগানিয়া। শুধুই কি আশা জাগানিয়া? আমরা যারা সংবাদপত্রে একটু আধটু ঢুঁ মারি তারা মোটামুটি অবগত আছি এ বিষয়ে। লেখার শুরুর দিকেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগের হিসাব অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ হতে যাচ্ছে; খোদ অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে। সত্যিই এসব আশা জাগানিয়া। তবে এইও মনে রাখতে হবে; বাংলাদেশ বিশ্বে অতি ধনী বৃদ্ধিতে বিশ্বে ১ম , শুধু ধনী বৃদ্ধির তালিকায় ৩য় এবং অতি গরীব বৃদ্ধির তালিকায় ৫ম। এসব পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে আপনার আমার মত আমজনতা খাবি খায় সত্য; তবে বোধকরি এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি- দেশ এগুচ্ছে কিন্তু গরীব এবং ধনীর মাঝে বিশাল এক দেয়াল তুলে দিচ্ছে। দেশ নিয়ে আশা হতাশা ঝেড়ে এবার দেশের তরুণ সমাজের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। কারণ একটি দেশের চালিকাশক্তি তথা তরুণ সমাজ যদি ভালো না থাকে তবে দেশের অর্জন একটা সময় শিকেয় বাধ্য। তরুণদের অবস্থা খুঁজতে গেলে অনেকখানি আশাহত হতেই হয়। আমাদের তরুণ সমাজ ভালো নেই। কারণ অতি সহজ; বেকারত্ব। বেকারত্বের করাল গ্রাসে তরুণরা বিপর্যস্ত।বেকারত্বকে সত্যিকার ভাবে পরিসংখ্যানের আলোকে বর্ণনা দেওয়া সহজ কাজ নয়।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তির বাইরে (বেকার) ছিল ৪ কোটি ৬৬ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ ধরনের কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।অর্থাৎ দেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী চাকরী বঞ্চিত অবস্থায় রয়েছে। আইএলও বলছে ২০১০-১৭ সালের মধ্যে বেকারত্বের হার ৬.৩২% থেকে বেড়ে ১২.৮% হয়েছে। অর্থাৎ বেকারত্বের হার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এই পরিসংখ্যান আহামরি কিছু বলছে না; বলছে না বেকারত্বের থাবায় তরুণ প্রজন্ম বিপন্ন হওয়ার কথাও, বলছে না কেন এই দেশে দিনকে দিন আত্মহত্যার পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই সবই পরিসংখ্যানের বাহিরের কথা। চলুন সমস্যা নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করা যাক। ফি বছর এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি না । একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর অসংখ্য গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অথচ দেখুন এই বিপুল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েটের তুলনায় আমাদের কর্মসংস্হানের পরিমাণ অতি নগন্য।স্বভাবতই শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের শীর্ষ পদগুলোতে যেভাবে বিদেশিদের আধিপত্য বাড়ছে তাতে করে আমাদের দেশের তরুণরা মুষড়ে পড়ছে। তরুণরা যারপরনাই হতাশ। বিদেশিদের আধিপত্যবাদের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের দক্ষতা এবং কর্মক্ষেত্রের সাথে অর্জিত জ্ঞানের যোগসূত্র। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এখন নৈ-বচ নৈ-বচ। যেন খেই হারিয়ে ধুঁকছে।মোটাদাগে বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে আদৌ কাজেই লাগছে না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে বুমেরাং হয়ে ফেরত আসছে। বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন- চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে তারা পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টিতে তারা যেন সিদ্ধহস্ত। হাল আমলের উবার সার্ভিস যেন তারই অন্যতম উদাহরণ।অথচ আমাদের দেশের তরুণরা উল্টো গঁৎবাধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। এখনকার তরুণরা সিভিল সার্ভিসকে পাখির চোখ করে রেখেছে। ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলো স্বভাবতই দেশের বাইরে থেকে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ বটে। প্রতিবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে শিক্ষার্থীদের বিপুল একটা অংশ কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার আবেদন করে। তার মধ্য থেকে ক্ষুদ্র একটা অংশ এই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। বর্তমান বিশ্ব উদ্যোক্তা তৈরিতে অধিক মনোযোগী হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে যোজন যোজন পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এখানকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ঝুঁকি নিতে অপারগ কিংবা এখানকার পরিবেশ ঝুঁকি নেওয়াকে অনুৎসাহিত করে। তাছাড়া উদ্যোক্তা হওয়ার প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করা অধিকতর কঠিন কাজ। ফলে তরুণরা বেকার থেকে যাচ্ছে। বেকারত্ব সমস্যার ঘেরাটোপে পড়ে আমাদের সমাজের একটা অংশ বখে যাচ্ছে। এদের হাতেই সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি যাচ্ছে। গবেষণা তাই-ই বলে; খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে এই বেকাররা বিভিন্ন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তি, টাকার বিনিময়ে খুন-খারাবী কিংবা বিভিন্ন নীতি বিবর্জিত কাজ বেড়ে যাবে। তাছাড়া অধিকতর হতাশা থেকে শিক্ষিত অথচ বেকার তরুণরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক রিজার্ভ কিংবা মাথাপিছু আয় এসব নিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতেই আমরা দিন পার করছি। অথচ তরুণ প্রজন্মের রঙিন স্বপ্নগুলো কখন অথবা কিভাবে যে রঙ হারাচ্ছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার সময়ই পাচ্ছি না।মনে রাখতে হবে, একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যতটুকু প্রয়োজনীয় ঠিক ততটুকুই প্রয়োজনীয় একটি দেশের তরুণ জনশক্তি। আজকের তরুণরা যদি শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা না পায়, তবে ভবিষ্যতের জন্য তা অশনিসংকেত হবে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পরবর্তী তরুণরা রাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তখন যে আমাদের উন্নয়নের পথে ধাবিত হওয়া অর্থনীতি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |