মাহির ফারহান খান, সিহাব হাসান নিয়ন যুগে যুগে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ তাদের যুগান্তকারী ধারণা দিয়ে অর্থনীতির পথচলায় এনেছেন আমূল পরিবর্তন। আমরা তাদের বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে হরহামেশ কথা বললেও তাদের পরিচয় মাঝে মাঝে ভুলে যাই। তাই আমাদের এই লেখা তাদের অবদানকে আরেকবার মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। এ পর্যায়ে আমরা আলোচনা করবো চার যুগান্তকারী অর্থনীতিবিদ নিয়ে। এডাম স্মিথ আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনক এডাম স্মিথ ১৭২৩ সালের ৫ জুন স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ক্লাসিকাল ইকোনমির একজন অন্যতম প্রবক্তা তিনি। “The Wealth of Nations” এর জন্য বিখ্যাত হলেও তার প্রথম গ্রন্থ “The Theory of Moral Sentiments” (1759)। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সারাজীবন পুঁজিবাদের পক্ষে কথা বলা এডাম স্মিথ এই গ্রন্থে দানশীলতা এবং মানুষের অন্যের প্রতি সহানুভূতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে মানুষ স্বার্থপর হলেও অন্যকে সাহায্য করতে ভালোবাসে এবং অন্যকে সাহায্য করার উপর ভিত্তি করেই কিভাবে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমাজে গড়ে উঠে। একই সাথে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে মানুষের ন্যায়ের প্রতি একটি আসক্তি আছে - কেননা এটি মানুষকে একটি সুন্দর সমাজ দেয়। “The Wealth of Nations” এ যদিও তিনি একদম ভিন্ন আলোচনা করেছেন। আগের গ্রন্থে অন্যের প্রতি সহানুভূতির কথা বললেও এই গ্রন্থে তিনি বলেছেন কিভাবে মানুষের ব্যাক্তিগত উন্নতির প্রতি নজর দেয়া উচিত এবং প্রত্যেকের ব্যাক্তিগত উন্নতি কিভাবে একটি সামগ্রিক উন্নত সমাজ দেয়। একই সাথে আলোচ্য গ্রন্থে তিনি “Laissez-faire” বা উন্মুক্ত বাজারকে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি উপকরণ হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে মুক্ত বাজারে যদি সরকারের প্রভাব না থাকে তাহলে “Invisible Hand” এর মাধ্যমে বাজার তার নিজের গতি খুঁজে নেয় এবং যা সমাজের জন্য কল্যাণকর। এছাড়াও এডাম স্মিথ অর্থনীতিতে GDP (Gross Domestic Product) এর ধারণা আনেন। এর আগে রাষ্ট্র তার সম্পদের পরিমাপ করতো সোনা ও রুপার মজুদের উপর ভিত্তি করে। এডাম স্মিথ এসে বলেন - রাষ্ট্রের উচিত তার সম্পদের পরিমাপ করা পণ্য ও বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে। এছাড়াও তিনি রাষ্ট্রদের একে ওপরের সাথে বাণিজ্য করতে উৎসাহিত করেন। সামগ্রিকভাবে এডাম স্মিথ এর অবদান আধুনিক অর্থনীতির ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে অনেক বেশি। কার্ল মার্ক্স কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) মূলত বিখ্যাত তার পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ সম্পর্কে ধারণার জন্য। তার বিখ্যাত দুটি কাজ হচ্ছে “Communist Manifesto” এবং “Das Kapital”। এডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডো দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও অর্থনীতির ব্যাপারে মার্ক্সের চিন্তাভাবনা তাদের থেকে অনেক ভিন্ন ছিলো এবং তার সমসাময়িক সময়ে তার চিন্তা ভাবনাকে অনেকেই সাদরে গ্রহণ করতে চায় নি। “Communist Manifesto” (১৮৪৮) তিনি রচনা করেন ফ্রেড্রিখ এঙ্গেলস এর সাথে যেখানে তিনি পূর্ববর্তী সমাজব্যবস্থাসমূহের বিবর্তন ও পুঁজিবাদী সমাজের স্বরূপ তুলে ধরেন। তিনি সেখানে ব্যাখ্যা করেন কিভাবে পুঁজিবাদ অনেক অস্থিতিশীল এবং সাম্যবাদ যেকেনো সমাজে পুঁজিবাদকে সরিয়ে অবশ্যই স্থান করে নিবে। তার সকল আলোচনা ছিলো মূলত একজন শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তিনি তার আলোচনায় পুঁজিবাদের ভালো দিক নিয়ে কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা কেন টিকবে না - সে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার পরের কাজ “Das Kapital” মূলত পুঁজিবাদের একটি সমালোচনা। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন সমাজ কিভাবে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত এবং কিভাবে পুঁজিপতি শ্রমিককে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক না দিয়ে মুনাফা একা ভোগ করে নেয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন শ্রমিকদের উপর পুঁজির এই শোষণের কারণেই কিভাবে শ্রমিকরা আন্দোলন করে পুঁজিবাদকে সরিয়ে সাম্যবাদ নিয়ে আসবে। মার্ক্সের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলো ভ্লাদিমির লেনিন ও জোসেফ স্ট্যালিন এর মত নেতারা। তার আদর্শের অনেক প্রভাব ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন , চায়না ও কিউবার মত দেশে। অর্থনীতিতে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার ধারণা প্রদানের জন্য তার নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল থাকবে। জন মেইনার্ড কেইনস বাজারকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে একে নিজের মতো ছেড়ে দিলেই চাহিদা ও যোগানের ঘাত-প্রতিঘাতে বাজারের সেরা অবস্থান নিশ্চিত হবে – এমনটাই ছিল ক্ল্যাসিকাল ইকোনমির ধারণা। এই ধারণা বড় রকমের একটা ধাক্কা খায় ১৯৩০ এর দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ে এসে। এই সময়ই অর্থনীতিতে নতুন এক ধারণা আসে যাকে পরবর্তীতে চিহ্নিত করা হয় ‘কেইনসিয়ান রেভ্যুলুশন’ হিসেবে। এই কেইনসিয়ান রেভ্যুলুশন যে মানুষটার তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে - সেই জন মেইনার্ড কেইনস ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে। তিনি শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইটন কলেজ ও কিংস কলেজে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভার্সাই শান্তিচুক্তির আলোচনায় কেইনস ব্রিটিশ ট্রেজারির প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি মত দেন যে জার্মানির উপর অধিক ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপালে তা একদিকে যেমন জার্মানির সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করবে পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে জার্মানির পণ্য আমদানির ক্ষমতাও হ্রাস করে দিবে। যা পরবর্তীতে অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকেও আঘাত করবে। কিন্তু সেইসময়ের রক্ষণশীল ব্রিটিশ সরকার তার এই মতামত মেনে নেয় নাই। কেইনসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ১৯৩৬ এ প্রকাশিত ‘The General Theory of Employment, Interest and Money’। ইউরোপ ও আমেরিকা যখন ইতিহাসের বৃহত্তম অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেইসময় কেইনস এই বইয়ে দেখান মন্দা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি। পরবর্তী কয়েক দশক কেইনসের নীতির উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের সরকারের অর্থনৈতিক খাত পরিচালিত হয়। ১৯৭০ এর স্ট্যাগফ্লেশন পরবর্তী সময়ে কেইনসের প্রভাব কমতে থাকলেও তা আবার অনেকটাই ফিরে আসে ২০০৭ এর ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস মোকাবিলা করতে যেয়ে। তার কাজের জন্য কেইনসকে বলা হয়ে থাকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ এবং আধুনিক ম্যাক্রোইকোনমিকসের জনক। অমর্ত্য সেন অমর্ত্য সেনের জন্ম ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বর, অবিভক্ত ভারতবর্ষের মানিকগঞ্জ জেলায়। তার পিতা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক। অমর্ত্য সেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। সেন মূলত ওয়েলফেয়ার ইকোনমিকস ও সোশ্যাল চয়েজ থিওরি নিয়ে কাজ করেছেন। তার মতে শুধুমাত্র জিডিপি কিংবা মাথাপিছু আয় দিয়ে মানুষের উন্নত জীবনযাত্রা কিংবা কল্যাণ নিশ্চিত করা যায় না। এর বিকল্প হিসেবে তিনি ‘ক্যাপাবিলিটি এপ্রোচ’ নামের নতুন একটি ধারণার প্রস্তাব করেন। ক্যাপাবিলিটি এপ্রোচের ধারণা অনুযায়ী মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির পেছনে যতটা না ‘তার কী আছে’ এই নীতি কাজ করে তার চেয়ে বেশি কাজ করে 'সে কী করতে পারে'। সেন তার গবেষণার জন্য ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
1 Comment
Jasmin Akter
2/3/2021 08:51:29 pm
অর্থনীতি বিষয়টা সহজে আয়ত্ব করতে পারিনা। যখনি মনে হয় ব্যপারটা বুঝতে পেরেছি তখনি সামনে আরেকটা প্রশ্ন এসে উপস্থিত হয়
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |