মোহাম্মদ জিলানী কিছু দিন আগে ও আমরা স্বপ্ন দেখতাম আর অনর্গল গল্প করতাম আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে। কেননা আমদের ছিল গৌরব উজ্জ্বল সাফল্য, সম্ভাবনার দুয়ার এবং সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রা। হঠাৎ করে চীনের উহান প্রদেশে তৈরী হওয়া এক অদৃশ্যহীন ভাইরাসের ধাক্কায় আমাদের স্বপ্ন ভেঙে উল্টো আামাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক অনিশ্চিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সম্মুখে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে অভাবনীয় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে গোটা পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলো । পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার জিডিপির পরিমাণ ছিল ২০.৪৯ ট্রিলিয়ন ডলার। এখন সবচাইতে কোণঠাসায় দিন পার করছে। ৯/১১ হামলাকে বলা হয় আমেরিকার ইতিহাসের কালো দিন যা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষের। আর এর বিপরীতে প্রতিশোধ হিসেবে পৃথিবী দেখেছিল কীভাবে আমেরিকা পাল্টে দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক রূপরেখা। যেই নিউইয়র্ক শহর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এপিসেন্টারে ছিল তা যেন আজকে করোনায় প্রাণনাশের এপিসেন্টারে পরিণত হয়েছে। করোনায় ৬৩ হাজারের বেশি মার্কিন নাগরিক মারা গেছেন এবং ১০ লাখেরও বেশি মার্কিন নাগরিক আক্রান্ত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মৃত্যুর হাহাকারে কাঁপছে মার্কিন মুলুক এবং ট্রাক বোঝাই লাশ দেখে ভয় পাচ্ছে বিশ্ব। করোনায় (রেকর্ড) ২২ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক গত মার্চে বেকার ভাতা ও অন্য সুযোগ সুবিধা দাবি করেছেন। এপ্রিলের গোড়ায় আরও কয়েক লাখ এই দাবিতে সামিল হয়েছেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ চীন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেক আগেই। দেশটি এখন পর্যন্ত ৩৩ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি অর্থমন্ত্রীর আত্মহত্যা,ইতালির প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে আর্তনাদ এবং বাকি দেশগুলোর মৃত্যুর সূচক আমাদেরকে সাক্ষ্য দেয় কিভাবে ভয়াবহ সময় পার করছে তারা। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এখন পর্যন্ত আমেরিকা ইউরোপ কিংবা চীনের ন্যায় ততটা প্রাণঘাতী না হলেও লকডাউন ও আতঙ্কে বিরূপ আর্থসামাজিক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউন বিরাজমান বলে সরাসরি এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। স্থগিত রয়েছে বড় বড় কারখানার উৎপাদন। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে পর্যটন খাত। বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ফ্লাইট। ঋণখেলাপির আশঙ্কায় বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনা ভাইরাসের কারণে এরকম বহুমাত্রিক আঘাতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে দেশীয় অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়। বাংলাদেশের আমদানিকৃত পণ্যের শতকরা ৯০ ভাগ আসে চীন থেকে। চীন থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসের কারণে এই আমদানিকৃত পণ্যের উপর ভাটা পড়েছে। পণ্য জাহাজীকরণ, বুকিং এবং বিক্রি ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। মেশিন, কাপড় কেমিক্যাল সহ তৈরি পোশাক খাতের অনেক কাঁচামাল যা চীন থেকে আসত তার ওপর একপ্রকার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আবার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে লকডাউন বিরাজমান বিধায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পোশাকশিল্প। গ্লোবাল ট্রেড ইম্প্যাক্ট অব দ্য করোনা ভাইরাস এপিডেমিক শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের বস্ত্র ও পোশাকশিল্প খাত, কাঠ ও আসবাব শিল্প এবং চামড়াশিল্পে বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। চীনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এর কারণে দেশের চামড়া শিল্পে ১৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বস্ত্র শিল্প ও আসবাব শিল্পে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে ১ মিলিয়ন ডলার করে। বাংলাাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসমস্ত পণ্য রপ্তানি করে এগুলো হলো : চামড়া, পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, তৈরি পোশাক ও মৎস্যজাতীয় পণ্য। যদি রপ্তানি কমতে শুরু করে তাহলে দেশের অভ্যন্তরে ঐ সমস্ত পণ্য উৎপাদনকারী শ্রমিকের আয় ও কর্মসংস্থানের অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।ভয়াবহ করোনায় বেকায়দায় রয়েছে প্রবাসীরা। অনেকেই আগের ন্যায় সমান মজুরি পাচ্ছে না। ফলে তাদের পরিবারগুলোর চাহিদা কমে যাচ্ছে।এতে করে স্থানীয় বাজারের বেচাকেনায় ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ও ক্ষতির মুখে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের হিসেবে সাধারণ ছুটির একমাসে দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১ লাখ ২ হাজার ৩শ কোটি টাকা। যা দৈনিক কমপক্ষে ৩৩০০ কোটি টাকা। কৃষি মৎস ও প্রাণিসম্পদ খাতে অর্থনৈতিক অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে প্রতিদিন ২শ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, শিল্প অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১শ ৩১ কোটি টাকা।তবে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার সেবা খাত। প্রতিদিনের ক্ষতি হচ্ছে ২০০০ কোটি টাকা। সবশেষে চলতি বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তাতে পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। করোনার কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু পদক্ষেপ অতি দ্রুত বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। যেমন : ১। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ প্রয়োজনের তুলনায় একদিক থেকে কম অন্যদিকে বাস্তবায়নের রয়েছে শত আশঙ্কা। কেননা এই প্যাকেজের বেশিরভাগই হচ্ছে ঋণমূলক ব্যবস্থা। ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ হারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিবে। ব্যাংক যাদের ঋণ দিবে তারা সত্যিকার অর্থে ঋণগ্রস্থ কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২। চিকিৎসা ও খাদ্য নিরাপত্তায় নজর দেয়া উচিত। এই মহামারী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যে কত ভঙ্গুর। সুচিকিৎসা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দক্ষ ও মানবতাবাদী লোক নিয়োগের বিকল্প নেই । ৩।কৃষককে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া যেন সুদমুক্ত ঋণ অথবা সুদের পরিমাণ আরও কমিয়ে আনা হয় পাশাপাশি কৃষি উপকরণের প্রাপ্যতা সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে শস্য উৎপাদনের পর ন্যায্য মজুরি পায় তার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হবে। ৪। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের উপায় খুঁজে বের করতে হবে । ৫। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এস্থার ডাফলো এর মতে, কয়েক সপ্তাহ পর যদি মানুষের হাতে টাকা না থাকে, তাদের ঘরে আটকে রাখা মুশকিল হয়ে যাবে। লকডাউনের সিদ্ধান্ত ব্যর্থ হবে। যদি মানুষ বের হতে শুরু করে, সমস্যা আরও বাড়বে। তবে মানুষের জীবন রক্ষার পাশাপাশি অর্থনীতি নিয়েও ভাবার সময় এখনই। লকডাউনের মাঝে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হবে। এত কিছুর মাঝেও আমাদের জন্য কিছুটা আশার বাণী হচ্ছে - চীনের কিছু ক্রয় আদেশ বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম কমায় এর আমদানি খরচ আগের চেয়ে কমবে যা শিল্পের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমাবে। সরকার কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারলে এর দ্বারা সাধারণ মানুষ ও উপকৃত হতে পারে। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কি কি ক্ষতি হবে এবং তা পুষিয়ে নিতে কি কি করতে হবে তা এখনই পরিপূর্ণভাবে বলা যাবে না। কারণ সময়ের সাথে সাথে এর ধরন , পরিস্থিতি ও বদলাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান, জার্মানির অর্থনীতি মজবুত করতে খুব বেশিদিন লাগেনি। মূলত সংকট নিরসনে এবং অর্থনীতিকে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে দরকার শক্তিশালী ও অবকাঠামোগত পদক্ষেপ এবং তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। মোহাম্মদ জিলানী সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের অর্থনীতি এবং নীতি নির্ধারণ নিয়ে চিন্তাশীল তরুণ। কলামিস্ট এবং প্রতিষ্ঠাতা, নলেজ এক্সচেঞ্জ হাউজিং।
1 Comment
Mohsin Chowdhury
5/14/2020 07:13:06 am
খুব সুন্দর উপস্থাপনা এবং বিশ্লেষণ। একজন অর্থনীতি বিভাগের স্টুডেন্ট হিসেবে এই ধরনের ব্লগের মাধ্যমে অনেক কিছু জানা সম্ভব হচ্ছে। ধন্যবাদ escdu টিম কে।
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |