মো.আহাদ আল আজাদ মুনেম, সাদিক মাহবুব ইসলাম, সুমাইতা তাবাসসুম খান নিলাম তো আমরা সবাই দেখেছি। একজন বাচাল নিলাম-ডাকিয়ে উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিলাম ডাকেন, আর হলভর্তি মানুষ দাম করেন। এমন নিলাম নানা জিনিস নিয়ে হয়। অনেকে তো আবার একে মজা করে ডাকেন- সুন্দরী প্রতিযোগিতা! নেদারল্যান্ডসের আলসমিইর ফ্লাওয়ার অকশন যেটি কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের নিলাম। এই নিলামের দালানটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ দালান যেখানে নিলাম হয় । এখানে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে ফুল আসে। এখানে ৩০ বার এদের মান মূল্যায়ন করা হয় । প্রতিদিন প্রায় দুইকোটি ফুল বিক্রি হয় এবং ভালোবাসা দিবস বা মা দিবসের মত বিশেষ দিনে ১৫% ছাড় দেয়া হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাছের নিলাম হল এক টুনা মাছের নিলাম। এটি অনুষ্ঠিত হয় জাপানের শুকিজি ফিস মার্কেটে। এই নিলামে শুধুমাত্র লাইসেন্স-ক্রীত দরদাতারাই অংশগ্রহণ করতে পারে। এদের মধ্যে থাকে পাইকারেরা যারা আড়ত এবং বাজারের মধ্যস্থতা করে এবং থাকে খুচরা বিক্রেতারা। এছাড়াও আছে লাইসেন্স-ক্রিত ক্রেতা যারা কিনা বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন কোম্পানিতে কাজ করে। এটি পর্যটকদের জন্যও একটি বিশেষ আকর্ষণ। সথবি বিভিন্ন বড় বড় আর্টিফ্যাক্টস নিলামে তোলে, সেসবের খবর আমাদের কাছে আসে। বেনামী ধনীব্যক্তিরা বহুমূল্য শিল্পকর্ম আর অ্যান্টিক্স ক্রয় করেন এত চড়া দামে, যা আমরা ভাবতেও পারিনা। কিন্তু আজকের দিনে যখন নিরাপত্তাব্যবস্থা, জ্বালানি এমনকি রেডিও-ওয়েভ পর্যন্ত নিলামে তোলা হয়। সেটা কীভাবে পরিচালিত হয়? এইখানেই আসে অকশন থিওরি- এটি এমন একটি গবেষণা যা ২০২০ সালের ভেরিয়াজেস রিকসব্যাঙ্ক ইন ইকোনোমিক্স সায়েন্স ইন দ্য মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল পদক লাভ করে।যা পেয়েছেন পল মিলগ্রাম এবং রবার্ট উইলসন নামক দু’জন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। অকশন থিওরি মূল আলোচ্য বিষয় হল নিলামের সম্ভাব্য ডিজাইন যার মধ্যে নিলামের ধরনের দক্ষতা, অনুকূল এবং ভারসাম্যপূর্ণ দাম হাঁকার কৌশল এবং দক্ষতার সাথে রাজস্ব তুলনা অন্তর্ভুক্ত। অকশন থিওরির সবচেয়ে বড় প্রয়োগ খুব সম্ভবত বেসরকারিকরণ এর ক্ষেত্রে। নিওলিবারেলিজমের খপ্পরে পড়ে ক্রমাগত সরকারি ও সমন্বিত খাতগুলোকে যখন ব্যক্তিমালিকানাধীন করা শুরু হলো,তখন সরকারের অন্যতম মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আয় করা।এই ক্ষেত্রে কাজে আসে অকশন থিওরি। অকশন থিওরি মূলত কাজ করে নিলাম এবং নিলামের সাথে জড়িতদের কার্যক্রম নিয়ে। অকশন বা নিলামে নানা রকমের চলক কাজ করে, সেখান থেকে কোন প্রকিয়া অনুসরণ করলে কোনো ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, রাষ্ট্র সর্বোচ্চ লাভবান হবে এবং কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব থাকবে না- এটা নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন। এই বিষয়ে অনেক বছর ধরেই কাজ করেছেন অর্থনীতিবিদগণ। শেষ হাসি হাসলেন পল মিলগ্রাম এবং রবার্ট উইলসন। নিলামের মাঝে গেইম থিওরি ব্যবহার করে সুষ্ঠুভাবে নিলাম পরিচালনা করার পদ্ধতি বের করেন তারা। ‘গেম থিওরি’ এর একজন বিশেষজ্ঞ মিলগ্রাম অকশন বা নিলামের জন্য একটি থিওরি আবিষ্কার করেছেন যাতে নিলামকৃত বস্তুর সাধারণ মূল্য নিয়ে কাজ করা হয়। এটি এমন একটি মূল্য যা প্রথমে অনির্ধারিত থাকে কিন্তু পরবর্তীতে সকল দরদাতার জন্য একই হয় যেমনঃ বেতার তরঙ্গ এবং খনিজ সম্পদের পরিমাণ। এছাড়াও মিলগ্রাম এমন একটি সাধারণ থিওরি প্রস্তাব করেন যেখানে বস্তুর সাধারণ মূল্য এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত মূল্য নিয়ে কাজ করা হয় যা কিনা একেক দরদাতার জন্য একেক রকম। তিনি এমন একটি নিলাম কৌশল উদ্ভাবন করেন যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিলামের ধরন দেখানো হয় যাতে বিক্রয়কারী উচ্চমূল্য এর রাজস্ব পাবে যদি দরদাতারা একে অপরের অনুমান ক্রীত মূল্য সম্পর্কে নিলামের সময়ই জানতে পারে। অপরদিকে উইলসন দেখানোর চেষ্টা করেন যে, যুক্তিসংগত দরদাতারা নিলামের জন্য সাধারণ মূল্য এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মূল্যটিই অনুমান করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিপত্তিতে পড়েন “উইনার্স কার্স” বা বিজয়ীর অভিশাপের জন্য। এই উইনার্স কার্স হলো এমন একটি অবস্থা যখন দরদাতা নিলামে তোলার দ্রব্যের মূল্য তার প্রকৃত মূল্যের চাইতে বেশি মনে করেন এবং তার জন্য এত বেশি ব্যয় করেন যার ফলে তার লাভ কমে যায়। এই অবস্থা এড়ানোর জন্য মিলগ্রাম এবং উইলসন এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যাতে একইসাথে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বস্তুর নিলাম করা যায় এবং বিক্রয়কারীর নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির চেয়ে সমাজসেবার লক্ষ্যটিই প্রাধান্য পেতে সক্ষম হয়। অকশন থিওরি বাস্তব-নিলামের নকশাকে তুলে ধরার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়; বিশেষত সরকারী সংস্থাগুলির বেসরকারীকরণ বা বিদ্যুত চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স বিক্রয়ের জন্য নিলাম তত্ত্ব বেশ প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে। এই ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় স্পেক্ট্রাম বা নেটওয়ার্ক ব্রডব্যান্ড বিক্রি করাও সরকারের অন্যতম লাভজনক রাজস্ব আয়ের মাধ্যম। এই পদ্ধতির শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন্স কমিশন (এফসিসি) প্রথমবারের মত এক নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে রেডিও-ওয়েভ বরাদ্দ দেয়ার জন্য। রেডিও-ওয়েভ অনেক তথ্য বহন করে, কাজেই এর মূল্য অপরিসীম। কিন্তু এই ওয়েভের মূল্য যথাযথভাবে দাম করা প্রায় অসম্ভব ছিল পূর্বে ব্যবহৃত লটারি বা সনাতন পদ্ধতিতে। এসময় এগিয়ে আসেন পল মিলগ্রাম। তিনি এক নতুন পদ্ধতি নিয়ে আসেন, যেটাই আধুনিক স্পেক্ট্রাম অকশনের ভিত্তি। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এখন এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ফোরজি ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ নিলামে তোলা হয়। এতে গ্রামীণফোন আর বাংলালিংক প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার দর দেয় এর জন্য। এছাড়াও ভারত, ব্রিটেন, ব্রাজিন, সুইডেনসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। তবে এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার থেকে যায়,যেমনটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে,অনুকূল ও ভারসাম্যপূর্ণ দামের সাথে সাথে দক্ষতার সাথে যতটা বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায়। এই বিষয়টি যে একমাত্র নিলামের মাধ্যমেই সম্ভব হয়ে ওঠে,সেটি এই তত্ত্ব থেকে আমরা জানতে পারি। অকশন থিওরি অন্যতম ধারণা হচ্ছে,প্রত্যেক গ্রাহকের কাছে নিলামে উপস্থাপিত বস্তুটির একটি ব্যক্তিগত মূল্য আছে।আর এই মূল্য নির্ধারিত হয় তাদের ব্যাক্তিগত তথ্যপ্রাপ্তি এবং উইনার্স কার্স সম্পর্কে ধারনা দিয়ে।যাঁর কাছে যত স্পষ্ট তথ্য এবং উইনার্স কার্স সীমা বেশি উর্ধ্বে তার বিড তত উর্ধ্বমুখী হবে। এতে দুটি বিষয় নিশ্চিত হয়ঃ ১) গ্রাহক দের মধ্যে যিনি বিজয়ী হবেন,তিনি স্পেক্ট্রামটির মূল্যায়ন সবচেয়ে বেশি করেন,আর একই কারণে তাঁর পক্ষেই সম্ভব দক্ষতার সাথে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা। ২) একইসাথে এটিও নিশ্চিত করে,যেন নিলামকারী, যা এক্ষেত্রে সরকার, তারা যেন সর্বোচ্চ সম্ভব রাজস্ব পায়। এছাড়া আরও একটি চমৎকার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় নর্দার্ন রক ধ্বসের পরবর্তী সময়ে।নর্দার্ন রক ব্রিটেনের একটি অতি পরিচিত ব্যাংক,যা ২০০৭ সালের দিকে নিজেদের নীতিনির্ধারণী কারণে দেউলিয়া হয়ে যায়।এর অগণিত ভোক্তা নিজেদের সঞ্চয় হারায়। এই অবস্থায় "ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড" কে কিছু মৌলিক সিদ্ধান্ত নিত হতো,এই ব্যাংক ও এর সেবা গ্রহণকারীদের রক্ষা করতে এবং মন্দা ঠেকাতে তারল্য বৃদ্ধি করতে।তখন তাদের সামনে একটিই পথ খোলা ছিল।সাধারণ সময়ের চেয়ে আরও বেশি জিনিস বন্ধকী হিসেবে গ্রহণ এবং একই সাথে তুলনামূলক দুর্বল বন্ধকীগুলোতে লোনের উপর সুদহার বৃদ্ধি।এই সমস্যার সমাধানে "ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড" প্রফেসর ক্লেম্পারের দ্বারস্থ হল। তিনি অকশ থিওরির একজন প্রথিতযশা গবেষক এবং থ্রিজি নেটওয়ার্ক স্পেকট্রাম লাইসেন্সিং এর অন্যতম নীতিনির্ধারক। প্রফেসর সমাধান দিলেন অকশন থিওরির একেবারে মৌলিক কিছু বিষয় থেকে।প্রফেসরের মতে, বন্ধকী গ্রহণ করা হয়, এমন জিনিস বৃদ্ধি করতে হবে,বিভিন্ন বন্ধকী বস্তুর গুণগত মানের উপর নির্ভর করে লোনের জন্য সুদহার বিভিন্ন হবে,বন্ধকী প্রদান করে লোন নেয়ার প্রবণতা থেকে প্রাপ্ত বাজার অবস্থাকে কম মানের বন্ধকীর পরিমাণ ও এর উপর সুদ হার প্রয়োগ করতে দিতে হবে,এখানে কোনো বাইরের প্রভাব রাখা যাবে না। নর্দার্ন রক ধ্বসের পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের অর্থনীতি সামগ্রিক ভাবে রক্ষা করতে এভাবেই অকশন থিওরির মূল বিষয়গুলো বিশাল ভূমিকা রেখেছিল,যা আবারও প্রমাণ করে,অর্থনীতির তাত্ত্বিক একটি বিষয়ও কতটা জীবনঘনিষ্ঠ। ই-বে বর্তমানে সবচেয়ে লাভজনক অনলাইন নিলাম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। বলা হয়ে থাকে, ই-বে পৃথিবীর একমাত্র পার্ফেক্টলি কম্পিটিটিভ মার্কেট। তার জন্য কোম্পানিটির অনন্য ব্যবসায়িক মডেলই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এটি বিভিন্ন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অব্যবহৃত ও ব্যবহৃত বস্তুও নিলামের জন্য স্বল্পমূল্যেএকটি দারুন প্লাটফর্মের সুযোগ করে দিয়েছে। এর প্রথম নিলামক্রিত বস্তু ছিল একটি ভাঙা লেজার পয়েন্টার যার মূল্য কিনা নির্ধারিত হয় ১৫ ডলার। একইসাথে এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্লভ খেলনা ও সংগ্রাহক বস্তু নিলামে তোলার মত কঠিন কাজটিও করে থাকে যা কিনা আকাশচুম্বী দামে বিক্রি হয়। এছাড়াও ই-বে এর ব্যবস্থাপনা দল এমন কর্মচারীদেরকে নিয়োগ দেন যারা কিনা ইন্টারনেট ইন্ডাস্ট্রির সদস্য নয়; ফলে তারা অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী থেকে লাভবান হতে পেরেছে। মোটাদাগে অকশন থিওরির প্রায়োগিক কয়েকটি সুবিধের কথা বলা যাক। প্রথমত, এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ির ঝক্কি-ঝামেলা কমে যায়- কারণ এটি একটি অনলাইন সিস্টেম। এর পাশাপাশি এর ফলে ছোট ছোট দরদাতাদের ওপর বড় দরদাতাদের প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়। এই নিলাম কয়েকদিন, এমনকি মাস পর্যন্তও চলতে পারে, ফলে সময়সীমা নিয়ে বাধ্যবাধকতা নেই। এ পদ্ধতিতে সবার জন্য একটি লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব হয়। সরকারও পায় সর্বোচ্চ রাজস্ব। কাজেই এমনটা ভাবা অমূলক নয়, নিলাম-ডাকিয়ের ‘এক কোটি টাকা এক’, ‘এক কোটি টাকা দুই’ এমন হাকাহাকির দৃশ্যকে জাদুঘরে পাঠিয়ে আমরা সর্বত্র এই ডিজিটালাইজড অকশন থিওরি এর প্রয়োগ দেখতে পাব।
1 Comment
Abu Ryhan
10/21/2020 12:32:54 am
নোবেলজয়ীদ্বয়ের নাম শুনার পরেও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত পড়তে আগ্রহী হই নি। কিন্তু ESC এর নোটিফিকেশন পেয়ে একদমে পুরোটাই পড়ে ফেললাম। লেখাটি অনেক ভলো লেগেছে।
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |