আব্দুল আহাদ, জিনাত জাহান খান, রাকিবুল ইসলাম, তানজিয়া তাসনিম আদীবা বিপর্যয়ে দেশের ব্যাংকিং খাত আব্দুল আহাদ বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের ন্যায়ে বাংলাদেশের আর্থিক খাতও ব্যাংকিং সেক্টরের উপর নির্ভয়শীল। তবে বর্তমানে সেক্টরটি নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনার কারণে উদ্বেগজনক সময় পার করছে। বিগত জুন মাস পর্যন্ত, শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর অনাদায়যোগ্য ঋনের হার দাঁড়িয়েছে ২৮.০২%, যা গত দশ বছরে সর্বোচ্চ। সোনালী, রূপালী, জনতাসহ প্রায় ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা না মেনে অধিক পরিমানে ঋণের যোগান দেওয়ায় এবং যথাসময়ে ঋণের টাকা আদায় করতে না পারায় এই মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে উক্ত ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির মোট পরিমাণ প্রায় ২৩,২৭০ কোটি টাকা। প্রতিবছর সরকার জাতীয় বাজেট থেকে প্রচুর আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে এই ঘাটতি মেটানোর জন্য। জনগণের ট্যাক্সের টাকা ব্যবহার করে ব্যাংকগুলোর অপারেটিং কস্টের যোগান দেওয়া হচ্ছে। তবে শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোই নয়, মূলধন ঘাটতিতে আছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও। এরমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক তাদের কোর ক্যাপিটাল (ব্যাংক নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকের মোট অ্যাসেটের যে অংশ নিরাপত্তার স্বার্থে জমা রাখতে হয়) ব্যবহার করা শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ খেলাপি এবং অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনাগুলোও ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্দশার অন্যতম কারণ। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ২৬০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারিতে ৪৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ সেই দুর্দশারই কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এছাড়া ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, ব্যাপারটিতে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। সোনালি ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংক তাদের মূলধন ঘাটতি সত্ত্বেও ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কিনতে বাধ্য হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতিগ্রস্থ এবং অনিয়মের শিকার এসব ব্যাংককে প্রতিবছর অর্থ সাহায্য না দিয়ে সরকারের উচিৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষনা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। রেমিটেন্স আয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ জিনাত জাহান খান গত ৮ই ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশ রেমিটেন্স অর্জনের দিক থেকে বিশ্বে নবম স্থানে রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয়। ইউএনবির রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয় উল্লেখযোগ্য হারে (১৭ দশমিক ৯ শতাংশ) বেড়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ ‘মাইগ্রেশন ও ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ’ প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের রেমিটেন্সের পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয় যে, এই বছর বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয়ের পরিমাণ ১৫.৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে বিশ্বে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স অর্জনকারী দেশ হলো ভারত যার রেমিটেন্সের পরিমাণ ৭৯.৫ বিলিয়ন ডলার। এরপরেই রয়েছে চীনের অবস্থান (৬৭ বিলিয়ন ডলার)। তৃতীয় এবং চতুর্থ অবস্থানে আছে মেক্সিকো এবং ফিলিপাইন। এই দুটি দেশের রেমিটেন্সের পরিমাণই ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আর পঞ্চম অবস্থানে ২৬ বিলিয়ন ডলার পরিমাণের রেমিটেন্স আয় নিয়ে রয়েছে মিশর। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের রেমিটেন্সের পরিমাণ ২০.৯ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব ব্যাংক ধারণা করছে যে, এই বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর রেমিটেন্স বাড়বে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। এতে করে বিশ্বজুড়ে রেমিটেন্সের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫২৮ বিলিয়ন ডলার। গত বছর এই বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৮ অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার রেমিটেন্স আয় বৃদ্ধির হার হতে পারে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। যা আগের বছর ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। ফলশ্রুতিতে, এই বছর দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাব্য রেমিটেন্স হবে ১৩২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোর রেমিটেন্স বৃদ্ধির হার হতে পারে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে রেমিটেন্স বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় বেশি হলেও বছরের শুরুতে এই বৃদ্ধির হার কমই ছিল। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন এজেন্সির দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে সাময়িকভাবে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রাখবে। অন্যদিকে সরকার নেপালের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করছে যা অনুসারে প্রবাসী শ্রমিকদের যাওয়া-আসা এবং বিবিধ খরচ শ্রমিকদের নয় বরং কোম্পানির মালিকদেরই দিতে হবে। দ্রুত বাড়ছে ধনী-গরিব বৈষম্য রাকিবুল ইসলাম গত দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে বিপরীতে বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার বৈষম্যও। সম্প্রতি সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ) এর এক সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। “বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জাতীয় নির্বাচন” শীর্ষক সভায় বক্তারা এসব তথ্য জানান। সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয় গত দশ অর্থবছরের প্রথম ৫ বছরের তুলনায় শেষ ৫ বছরে কমেছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম এর গুণগত মান। দ্বিতীয় ভাগে সরকারি উদ্যমের কিছুটা ঘাটতির কারণে এরকম হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বক্তারা। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কমার ফলে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা কমে গেছে। এছাড়াও উন্নয়নমূলক কাজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে হওয়ায় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল শতকরা ৮১.৮ ভাগ। ২০১৭ তে তা কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৭৫ ভাগে। Wealth X নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে দেখা যায় অতি ধনী বৃদ্ধির হারে পুরো পৃথিবীতে শীর্ষে বাংলাদেশ। যাদের সম্পদ বাংলাদেশি টাকায় ২৫০ কোটির ওপরে তাদেরকে অতি ধনী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। Wealth X এর প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে অতি ধনী বৃদ্ধির হার শতকরা ১৭.৩। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের শতকরা ১৩.৭। এরপর যথাক্রমে ভিয়েতনাম, কেনিয়া এবং হংকং। প্রতিবেদনে ধনী দরিদ্রের আয় বৈষম্য ফুটে উঠেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য মাপার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পরিমাপক "জিনি সহগ"। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো এর খানা আয়-ব্যয় এর হিসাবে জিনি সহগ এর মান ২০১০ সালে ছিল ০.৪৬৫। ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ০.৪৮৩ এ। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে জিনি সহগ ছিল ০.৩৭। জিনি সহগের মান বৃদ্ধি ধনী দরিদ্রের বৈষম্য তুলে ধরে।জিনি সহগের মান ০.৫ কে উচ্চ বৈষম্যের নিম্নসীমা ধরা হয়। বর্তমানের গতিতে বৈষম্য বাড়লে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়ার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থার আরো অবনতি ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে। দশ বছরে এক লক্ষ কোটি টাকা সুদ তানজিয়া তাসনিম আদীবা যদিও সরকার থেকে বলা হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামীণ সঞ্চয় আহরণ, সঞ্চয় কার্যক্রমে জনগণকে উৎসাহিত করা এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সঞ্চয়পত্র চালুর উদ্দেশ্য, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এবারের জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে প্রার্থীরা যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং তাঁদের পরিবারবর্গই বেশিরভাগ সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন। দেশে বর্তমানে প্রায় ১১ ধরনের সঞ্চয় কর্মসূচি চালু রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সরকারকে বেশি সুদ দিতে হয় পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে। মূলত এইধরনের সঞ্চয়পত্রগুলোই ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের জন্য কিনে রেখেছেন, যার ফলে সাধারণ মানুষের পরিবর্তে তাঁরাই এর বেশিরভাগ সুবিধা নিতে পারছেন। সরকার গত ১০ বছরে সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সুদ দিয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, এই ১ লাখ কোটি টাকা সুদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না, কারণ এর ৯০ শতাংশই গেছে সমাজের প্রভাবশালীদের কাছে। তাছাড়া সরকারকে এই বিশাল সুদ দিতে হচ্ছে জনগণের করের টাকা থেকে। বার্ষিক বাজেটের বড় একটি অংশ বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ। অর্থ মন্ত্রনালয়ের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রায় সব বৈঠকেই বলা হচ্ছে যে এই উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ঝুঁকি। পাশাপাশি যেহেতু গ্রাহকদের কাছে তাঁদের অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয় না, তাই এগুলো কালোটাকার মালিকদের জন্যেও বেশ ভালো বিনিয়োগ। সঞ্চয় অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই এই ঝুঁকি থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব এনেছে এবং আগামী বছরে পুরো খাতকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিলো যুগ্ম নামে, নাবালকের নামে ও প্রতিষ্ঠানের জন্য সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ বন্ধ রাখা, বিক্রির উচ্চসীমা ৩০ লাখ টাকায় নামিয়ে আনা ও জাতীয় পরিচয়পত্রকে বাধ্যতামূলক করা। কিন্তু এসব প্রস্তাব কার্যকর হতে দেননি সেসব নীতিনির্ধারকেরাই, যাঁরা সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের সুবিধাভোগী।
1 Comment
Shamim
1/4/2019 01:08:35 am
Awesome. Hats off to you from Melbourne. Keep it up dear juniors geniuses. Feeling nostalgic. Visualising 2008-2012 DU eco days. Proud to be an ex ESC executive member 2010.
Reply
Leave a Reply. |
Send your articles to: |