ইএসসি ব্লগ সম্পাদকীয় প্যানেল চীনের উহান প্রদেশ থেকে পুরো বিশ্বের ১৯৬ টি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কীভাবে এটি সারা পৃথিবীর সকল মানুষের মনে আতংক সৃষ্টি করেছে এবং লাখ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে তা সবই আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি। যখন পুরো বিশ্ব আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে এই ভাইরাসের প্রতিষেধকের জন্য তখন করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন সংকট নিয়ে আমাদের আলোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেই সংকট হচ্ছে আসন্ন তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। করোনাভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বের বৃহৎ শিল্পগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং ক্ষতির পরিমাণ দিনকে দিন বাড়ছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং শ্রমিকেরা চাকরি হারাচ্ছে। এর ফলে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে লক্ষাধিক দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিক এবং কারখানা শ্রমিকেরা চাকরি হারানোর আশংকায় রয়েছে। এছাড়াও রিকশাচালক ও অন্যান্য নিম্ন আয়ের মানুষেরা দিনের আহার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই আসন্ন মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় এই লেখায় ইএসসি বিশেষজ্ঞদের মতামতগুলো তুলে ধরেছে এবং সরকারের পদক্ষেপ পর্যালোচনা করেছে। বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের মতে বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে যদি না সরকারি পর্যায় হতে সামাজিক অর্থনৈতিক সুরক্ষা, চাকরির সুরক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য কর মওকুফ ইত্যাদি নিশ্চিত করা না হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা নানামুখী মত দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ড.জাহিদ হোসেনের মতে বাংলাদেশের অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতকে চাঙ্গা রাখতে সমগ্র জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। এছাড়াও তিনি বলেছেন বিভিন্ন আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর সাথে সংযোগ স্থাপন, ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে নিঃশর্ত অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। একই সাথে তিনি সম্পদের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে নিয়মমাফিক বেতন প্রদান, কর মওকুফ ইত্যাদি পলিসির ওপর জোর দিয়েছেন। ইন্সটিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মুস্তফা কে মুজেরি বেসরকারি খাতের লোকসানের কারণে সৃষ্ট রাজস্ব সংকট থেকে আগামীতে দেশের জাতীয় বাজেটে ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিং এর মাধ্যমে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর ইনডিপেনডেন্ট রিভিউ অফ বাংলাদেশ’স ডেভেলপমেন্ট এর টিম তাদের নিজস্ব মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরে। তাদের মতে বিদেশফেরত প্রবাসীরা দেশের শ্রমবাজারে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। শ্রমবাজারে চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রপ্তানি নির্ভর তৈরি পোশাক শিল্পে কম খরচে ঋণ সুবিধা চালু করার পক্ষে মত দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ যাতে সময়মতো শ্রমিকদের বেতন ও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এছাড়াও তারা সরকার কর্তৃক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য মিটিগেশন ফান্ড গঠন করার পক্ষে পরামর্শ দেন যেখানে ৫% সুদে ঋণ নেবার সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ব্যাংকিং খাতকে তারল্য সংকট থেকে মুক্ত করতে পলিসি রেট কমিয়ে সরকারকে ট্রেজারি বিল কেনার পরামর্শও দিয়েছেন তারা। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যদ্রব্য রেশনের ব্যবস্থা সহ পরিবহন ও পর্যটন খাতের জন্য অর্থ সহায়তা বরাদ্দ করার কথাও বলেছেন তারা। সিপিডির বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিরাও তাদের নিজস্ব মতামত দিয়েছেন কীভাবে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর সম্মানিত ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন করোনা মহামারী ৩১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ৪০%-কে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। তিনি আরও যোগ করেন যে দেশের এত উন্নয়ন হবার পরেও অর্থনৈতিক দূর্যোগ মোকাবেলার প্রস্ততিতে বাংলাদেশের ঘাটতি রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন স্বাস্থ্যসেবায় বৈশ্বিক অনুদানের পক্ষে গুরুত্ব দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বলেছেন সরকারের এই মুহূর্তে উচিৎ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী বিস্তৃত করা ও অনানুষ্ঠানিক খাতে অর্থ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা। সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন সেবা ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু করা উচিত। ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার এর এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ড.হোসেন জিল্লুর রহমান ৩টি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করেছেন যা আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ক্ষেত্রগুলো হলঃ রপ্তানি নির্ভর শিল্প যেমন গার্মেন্টস শিল্প যা পুরোপুরি বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়টি হল দেশের উদ্যোক্তাগোষ্ঠী যাদের সরবরাহ নির্ভর করে আমদানিকৃত কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির ওপর। এবং সবশেষে তৃতীয় ক্ষেত্রটি হল নিম্ন ও নিম্ন মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠী। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন শহরে বাস করা খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি দৃষ্টি নিপাতের জন্য যাদের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার সাথে তুলনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন যে, আগামী দুই মাসের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিও একই পরিণতি বহন করবে। তিনি অর্থনীতিবিদ এবং বিভিন্ন সংগঠনকে আহ্বান জানিয়েছেন পুরোপুরি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর না করে নিজেরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করে এই সংকট থেকে মুক্তির একটি উপায় খুজে বের করার জন্য। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড.নাজনীন আহমেদ বলেছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মূলত দেশীয় বাজারের জন্য উৎপাদন করে। ফলে তাদের আয় নির্ভর করে দেশীয় চাহিদার উপর। যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে দেশীয় চাহিদা কমে যাচ্ছে তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তিনি আরও বলেন যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি, স্বল্প সুদে ঋণের তহবিল গঠন ইত্যাদি প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে। একই সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করে কর্মী ছাঁটাই রোধ করতে হবে। স্বল্পসুদে জরুরী ভোগ্যপণ্যের ঋণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। বর্তমান সময়ের কথা বিবেচনা করে স্বল্পমেয়াদী ভোগ্যপণ্যের ঋণ সুবিধা চালু করা সবচেয়ে যৌক্তিক। সার্বিকভাবে,অর্থনীতিবিদদের প্রদত্ত পরামর্শগুলো হল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বিস্তৃতকরণ, সাময়িকভাবে কর মওকুফ, বেতনাদি সময়মতো প্রদান, ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থ হস্তান্তর, নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তা করার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান। সরকার কী করছেন ইতোমধ্যে সরকারের অনেক সমালোচনা করা হয়েছে এই নিয়ে যে তারা অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধের পদক্ষেপ নিতে অনেক গাফিলতি প্রদর্শন করছেন। তবুও ২৩ মার্চ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ নিরসনে কিছু পরিকল্পিত কর্মপন্থা তুলে ধরে। অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে শহরে বাস করা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খোলাবাজারে সেনাবাহিনী দ্বারা ৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ২৫ মার্চ তার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে চাল প্রতি কেজি ১০ টাকা বলে ঘোষণা করেন। তিনি আরও বলেন ১৭.৫১ লাখ টন মজুদকৃত চাল ও গম এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে। সরকার একই সাথে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও শ্রমিকদের বকেয়া ও চলতি মজুরি প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। চাকরির সুরক্ষা প্রদান করার ঘোষণাও সরকারের কাছ থেকে এসেছে। সেক্ষেত্রে সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে যাতে শিল্প কারখানার শ্রমিকদের বেতন ও মজুরি নিশ্চিত করা যায়। সুদবিহীন ঋণ প্রদান ও ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর কথাও সরকারের কাছ থেকে এসেছে। রপ্তানি নির্ভর শিল্প ও এনজিওর ক্ষেত্রে আগামী জুন মাস পর্যন্ত ঋণ মওকুফ করা হয়েছে। আমদানিকারকদের বিল প্রদানের সময়সীমা ২মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। রপ্তানি পণ্য বাজারে আনার সময় ৪ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিভিন্ন সহযোগী উন্নয়ন সংস্থা থেকে সরকার অনুদান গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছে। আইএমএফ থেক ৭৫০ মিলিয়ন, বিশ্বব্যাংক থেকে ১০০ মিলিয়ন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ৫০০ মিলিয়ন এবং জেদ্দাহ নির্ভর ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান পাবার কথা ঘোষণা করেছে সরকার। কেবিনেট সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যারা এই দুর্যোগে শহরে থাকার মত অর্থ উপার্জন করতে পারছে না তারা যদি নিজ গ্রামে ফিরে যেতে চায় তাহলে তাদের ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’ এর মাধ্যমে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে। এছাড়াও সরকার এক লাখ গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে আবাসনের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও উক্ত স্থানে এর আগে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। গৃহহীন জনগোষ্ঠী কতদিন সেখানে অবস্থান করতে পারবে বা তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করা হবে কিনা এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। অর্থ হস্তান্তর ও মোবাইল ব্যাংকিং এর সীমাও সরকারকর্তৃক বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও সরকার বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেবার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কাদের এবং কোথায় এই সেবা দেয়া হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য এখনো আসেনি। সবশেষে গত ২৬ মার্চ বিজিএমইএ এর সভাপতি রুবানা হক গার্মেন্টস মালিকদের চিঠির মাধ্যমে সকল গার্মেন্টস কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের দেওয়া অধিকাংশ মতামতই সরকার বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আদৌ এসকল ঘোষণা বাস্তবায়ন করা হবে কিনা তা এখনো অনিশ্চিত। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সাত বছর পার হয়ে গেলেও সকল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। করোনাভাইরাসের এই মহাদুর্যোগে যখন বিশ্বের সকল শক্তিশালী অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন তখন বাংলাদেশে তা কি পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে তা একমাত্র সময়ই বলতে পারবে। রেফারেন্সঃ ১. প্রথম আলো [১] [২]
২. দি ডেইলি স্টার [১] [২] [৩] ৩. দি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস ৪. দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ৫. নিউ এইজ বিডি
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |