সাফা তাসনিম, সামিহা ইসলাম, নিশাত তাসনিম আনিকা, ফারহানা আকতার, অভীক রেহমান, ওমর রাদ চৌধুরী ভাষা আন্দোলন এ দেশের সমগ্র জাতির মুক্তি আন্দোলনের সূতিকাগার। এটিকে একটি ‘ক্ষুদ্র গণ্ডির’সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে কখনো কখনো বিবেচনা করা হলেও মূলত পাকিস্তানি রাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে শোষণ ও দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টার জোরালো প্রতিবাদ করার মাধ্যম হিসেবে ভাষাকে বেছে নেয়া হয়। তবে এটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, ভাষা আন্দোলনকে সুস্পষ্টভাবে বোঝার জন্য এই সারসংক্ষেপ যথেষ্ট নয়। এটি শুধু একটি সাধারণ ধারণা দিতে পারে মাত্র।
ঔপনিবেশিক শক্তির দেশীয় সহযোগীরাই কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির উপর শোষণ, নির্যাতন চালায় তা খুবই স্পষ্ট। এই আঞ্চলিক নির্যাতন জনসাধারণকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে এবং এই শোষণ এর প্রতিবাদ করে সকলে একসাথে।ভাষা আন্দোলনের শ্রেণী ভিত্তি এবং রাজনৈতিক প্রবণতাসমূহের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে উপস্থাপিত হয়েছে--
কিন্ত এই বক্তব্য দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাবের সাথে।
প্রদত্ত তথ্যে ৭০ শতাংশই জানিয়েছেন ,তারা তখনই সচেতন ছিলেন যে উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। ১৯৪৮-১৯৫২ কালপর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদের ওপর কেন্দ্রের তরফ থেকে নানান আঞ্চলিক বৈষম্য,শোষণ ও নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিলো এবং গভর্নর মোনায়েম খান প্রভৃতি সুবিধাবাদী দালাল ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশ এ ব্যপারে সচেতন ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রবণতাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ভাষা আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী এবং প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত সকলেই অংশ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ইকোনমিক্স স্টাডি সেন্টারের মডারেটর এম এম আকাশ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ৩টি রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে চিহ্নিত করেছেন: ১। ইসলামী সাম্যবাদী চিন্তাধারা; ২। পাশ্চাত্য উদারনৈতিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা; ৩। বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা। ভাষা আন্দোলনকে পর্যালোচনা করার জন্য এর শ্রেণী বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরী। অধ্যাপক আকাশ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন বিভাগপূর্ব মুসলমান মধ্যবিত্ত বৃহত্তর শত্রু হিসেবে বিবেচিত ‘হিন্দু মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত’-এর বিরুদ্ধে একত্রিত হলেও মুসলমান অবাঙালী বনাম বাঙালী মুসলমানের দ্বন্দ্ব, বাঙালী অভিজাত বনাম বাঙালী কৃষকের দ্বন্দ্ব, ঔপনিবেশিক-সামন্তবাদী পশ্চাৎপদতা বনাম আধুনিক উদারনীতিবাদের দ্বন্দ্ব পরবর্তীতে অতিক্রম করতে পারেনি। ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সূত্র অনুসরণ করেই এই দ্বন্দ্বগুলো পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে আরো বিকশিত হয়েছে; পাকিস্তানের প্রাথমিক ঐক্য শ্রেণীস্বার্থের অনিবার্য গতিশক্তির সামনে বিপর্যস্ত হয়েছে। ভাষার প্রশ্নটির সাথে সরাসরি অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষণ জড়িত। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরী হতে থাকে। উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে এমনিতেই অবহেলিত বাঙালী জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পরিসরে সুযোগ ও অধিকার কমে যাবে, বিদ্যমান বৈষম্য আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, সেটি বুঝতে তৎকালীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অসুবিধে হয়নি। সাধারণ জনগণও এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ফলে ভাষা আন্দোলন ছিলো একটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শ্রেণীদ্বন্দ্বের একটি অনিবার্য ফল যার শেকড় ছিলো বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে। তথ্যসূত্র১। ভাষা আন্দোলন: পরিপ্রেক্ষিত ও বিচার, আতিউর রহমান ও লেনিন আজাদ
২। ভাষা আন্দোলন: অর্থনৈতিক পটভূমি, আতিউর রহমান ও লেনিন আজাদ ৩। ভাষা আন্দোলন: শ্রেণীভিত্তি ও রাজনৈতিক প্রবণতাসমূহ, এম এম আকাশ
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |