লেখা: শেখ আবরার হোসেন গ্রাফিক্স: অনির্বাণ ঘোষ শঙ্খ মানি লন্ডারিং কি? মানি লন্ডারিং শব্দটা আমরা সবাই শুনেছি কমবেশি। সরলভাবে যার অর্থ টাকা পাচার। কিন্তু এটির বিস্তারিত সংজ্ঞাটি হলো- অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত সম্পদ কিছু জটিল প্রক্রিয়ায় কয়েক ধাপে স্থানান্তর করে অর্থনীতিতে পুনরায় বৈধ সম্পদ হিসেবে আবির্ভাব করানোকে বলা হয় মানি লন্ডারিং। মানি লন্ডারিং এর মূল লক্ষ্যই হল আয়ের প্রকৃত উৎস ও মালিকানা লুকানো। “মানি লন্ডারিং” শব্দটির উৎপত্তিস্থল নিয়ে ২টি জনপ্রিয় মতের প্রচলন আছে। এক. আমেরিকার সংবিধানের ১৮ তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত ‘প্রহিবিশন এজ’–এ (যখন সকল ধরনের ড্রাগ উৎপাদন, পরিবহন, বিক্রি অবৈধ ঘোষণা করা হয়) উদীয়মান কুখ্যাত গ্যাংস্টার আলকাপন ও তার দোসররা অবৈধভাবে ড্রাগ উৎপাদন, বিক্রি থেকে উপার্জিত অঢেল সম্পদ বৈধকরণের জন্য লন্ড্রোম্যাটসের ব্যবসা শুরু করে। এই জামাকাপড় পরিষ্কার করার ব্যবসার আড়ালে কালো টাকা পরিষ্কার করে সাদা করা হতো, তাই অনেকের দাবি এখান থেকে “মানি লন্ডারিং” শব্দটির উৎপত্তি। Prohibition Age দুই. দ্বিতীয় মতানুসারে , ১৯৭০ এর দশকে নিক্সন প্রশাসনের আমলে রাজনৈতিক ক্যামপেইন চালানোর জন্য অবৈধভাবে অর্জিত টাকা শেল কোম্পানি আর অফশোর একাউন্টের মাধ্যমে ব্যবহার করার সময়ে এই শব্দটির প্রচলন হয়। মানি লন্ডারিং এর কিছু জগৎকুখ্যাত উদাহরণ হলো ২০০৭-২০১৫ এর মধ্যে ডেনমার্কের ডান্স ব্যাংকের এস্তোনিয়া ব্রাঞ্চ কর্তৃক ২৩৬ বিলিয়ন ডলার (মতান্তরে ৮০০ বিলিয়ন ইউরো) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার। এরপর ব্রিটিশ আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি কর্তৃক এক দশক ধরে ৮৮১ মিলিয়ন ডলার পাচার, যা ধরা পড়ার দরুন ২০১২ সালে ১.৯ বিলিয়ন ডলারের জরিমানা প্রদান। ১৯৯১ সালে বিলুপ্ত পাকিস্তানের বিসিসিআই ব্যাংক কর্তৃক ২০ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার। মানি লন্ডারিং এর ইতিহাস মানি লন্ডারিং এর সূত্রপাতের সঠিক ইতিহাস তো আর বলা সম্ভব নয় তবে, মার্কিন ঐতিহাসিক স্টার্লিং সেগ্রেভের মতে এই আর্থিক অপরাধের সূত্রপাত ২০০০ সালেরও আগে। প্রাচীন চীনের আঞ্চলিক সরকারের নানা ধরনের বাণিজ্য-বিমুখী নিয়মের কারণে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কালোবাজার, চাঁদাবাজি, ঘুষ থেকে উপার্জিত কালোটাকা সাদা করার রীতি তখন থেকেই ছিল। তারা কালোটাকা দিয়ে ট্যঞ্জীবল (ভৌত) মূল্যবান সম্পদ কিনে রাখতো যা পরবর্তীতে দরকারে বিক্রি করে ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ করত। মানি লন্ডারিং এর ধাপসমুহঃ মানি লন্ডারিং সাধারণত তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে। প্লেসমেন্ট, লেয়ারিং, ইন্টিগ্রেশন। নিম্নে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। প্লেসমেন্ট: লন্ডারিং এর প্রাথমিক স্তর এটি। অবৈধ সম্পদ অর্থনীতিতে আনয়ন করা হয় এই স্তরে। পাচারকারী এই স্তরে মূল যে কাজটি করে তা হলো, উৎস থেকে অবৈধ সম্পদের পৃথকীকরণ। সেজন্য সে নানা ধরনের পথ অবলম্বন করে। যেমন: নতুন একাউন্ট খুলে বা না খুলে ছোট ছোট পরিমাণে ব্যাংকে অর্থ জামানত রাখতে পারে, এমাউন্টটি ছোট থাকায় এভাবে কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দেয়া সহজ ; কিংবা সে হয়তো কোনো মূল্যবান বস্তু ক্রয় করে থাকতে পারে, যেমন: কোনো মূল্যবান ছবি বা ভোগ্যপণ্য অথবা রিয়েল এস্টেট বিজনেসে বা কোনো ধরনের বিজনেসে বিনিয়োগ করতে পারে। এভাবে সে অবৈধ সম্পদকে ওই দেশের ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমে প্রবেশ করায়। লেয়ারিং:: এই স্তরটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তরের মূল লক্ষ্য হলো কালোটাকা আর সাদা টাকাকে একত্রীকরণ, সেজন্য কিছু জটিল পদ্ধতিতে কয়েক ধাপে একাধিক ট্রানজ্যাকশন করা হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে। দেশের মধ্যে, দেশের বাহিরে, ভিন্ন মালিকানায় একাধিক একাউন্ট খুলে ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় এক জায়গা থেকে টাকা আরেক জায়গায় সরানো হয়। এভাবে এত বেশি টাকা সরানোতে (আবার ভিন্ন নামেও সরানোতে) টাকার উৎস ও মালিক খোজা খুবই দুঃসাধ্যকর হয়ে পড়ে। প্রতিটি ট্রানজ্যাকশনের লক্ষ্য থাকে ক্রমান্বয়ে শিথিল থেকে শিথিলতর রেগুলেশনের ব্যাংকে ট্রান্সফার করা। আর দেশের বাইরে টাকা নিতে গেলে এমন দেশে পাচার করা যেখানে নামমাত্র ব্যাংকিং রেগুলেশন বিদ্যমান, কড়াকড়ি বলতে গেলে নেই। এসব দেশকে নানা নামে অভিহিত করা হয়ে থেকে যেমন: ট্যাক্স হেভেন, শেল কোম্পানি হেভেন, লন্ড্রোম্যাটস, ব্যানানা রিপাবলিক, ট্রেজার আইল্যান্ড, পিগি ব্যাংক ইত্যাদি। দেশগুলো হলো – কেইমেন আইল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, সাইপ্রাস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, পানামা, হংকং, সিঙ্গাপুর, মোনাকো, মালটা ইত্যাদি। ইন্টিগ্রেশন:: এটি সর্বশেষ স্তর। এই স্তরে অবৈধ অর্থ সম্পূর্ণ বৈধরূপে অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এখানে মালিকের পরিচয় জ্ঞাত থাকে। মানি লন্ডারিং এর পরিচিত কিছু পদ্ধতি: এই অপরাধটি করার তরিকা প্রতিনিয়তই উন্নত হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। নতুন নতুন পদ্ধতির আবির্ভাব হচ্ছে। যেমন আগে ডিজিটাল কারেন্সির ব্যবহার ছিল না, এখন সেটা ব্যবহার করেও মানি লন্ডারিং হচ্ছে। এমনি কিছু পদ্ধতির আলোচনা করা হলো: ১. স্মার্ফিং: স্মার্ফিং এর আরেক নাম স্ট্রাকচারিং। ১৯৫৮ সালে বেলজিয়ান কমিক আর্টিস্ট পিয়েরে কালিফোর্ডের দুনিয়াখ্যাত অনবদ্য সৃষ্টি, কমিক ফ্র্যাঞ্চাইজি “দ্যা স্মার্ফস” এর আদলে এই নামানুকরণ। স্মার্ফরা আকারে ছোট, সবসময় একসাথে থাকে, পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ করে। তাদের মতো এই পদ্ধতিটিতেও মানি লন্ডারিংটি ছোট পরিমানে, বারবার অবৈধ সম্পদ এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয় বলে এই পদ্ধতির নাম দেয়া হয় স্মার্ফিং।সাধারণত ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে যেটা অতিক্রম করলে কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। তাই লক্ষ্য রাখা হয় যেন প্রতিটি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পরিমাণটি এই মাত্রার নিচে থাকে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ১০,০০০ ডলার এর বেশি একবারে স্থানান্তর করতে গেলে আগে ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষকে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট শাখায় (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক)-এ একটি কারেন্সি ট্রানজ্যাকশন রিপোর্ট ফাইল করা লাগে, অতঃপর অনুমতি সাপেক্ষে ট্রানজ্যাকশন করতে দেয়া হয় । সাধারণত ড্রাগ ট্রাফিকিং, অবৈধ জুয়া থেকে উপার্জিত টাকা এই পদ্ধতিতে চোরাচালান করা হয়। ছোট ছোট পরিমাণে টাকা স্থানান্তর এর দরুন আইনের চোঁখ ফাঁকি দেয়া সহজ হয় The Smurfs ২. ক্রিপটোকারেন্সি ও ডিজিটাল এসেট: ক্রিপটোকারেন্সির বিশিষ্ট বৈশিষ্টের কারণে বর্তমানে এই পদ্ধতিতেও মানি লন্ডারিং প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। অবৈধ টাকা দিয়ে ডিজিটাল মুদ্রা কিনে মিক্সার্স, টাম্বলারস, চেইন-হপিং ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় অপরাধী মালিকানা গোপন করতে সক্ষম হয় এবং অর্থের প্রকৃত মালিকানা তখন খুঁজে বের করা পুরোপুরি অসম্ভব হয়ে পড়ে। ডিজিটাল মুদ্রার এই বিকেন্দ্রিক ও সহজেই অজ্ঞাত করে ফেলার বৈশিষ্টের জন্য মানি লন্ডারিং এর অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাইবার্ক্রাইম, ড্রাগ ট্রাফিকিং, টেরোরিস্ট ফাইন্যান্সিং ইত্যাদি কাজের জন্য এই পদ্ধতিতে মানি লন্ডারিং করা হয়ে থাকে। ৩. ট্রেড-বেজড মানি লন্ডারিং: এ পদ্ধতিতে সাধারণত আমদানি-রপ্তানির সময়ে অর্থ চোরাচালান করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতির জন্য ক্ষমতাসীন দলের সাথে রাজনৈতিক সখ্যতা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। পণ্যের ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে প্রকৃত মূল্য গোপন করে বাকি মূল্যের সমান পরিমাণ টাকা পাচার করে। যেমন আন্ডার ইনভয়েসিং এ দুই কোটি মূল্যের আমদানিকে এক কোটি মূল্যের সমান দেখিয়ে এক কোটি টাকা বৈধভাবে পরিশোধ করে বাকি এক কোটি অবৈধ টাকা দিয়ে পরিশোধ করার মাধ্যমে পাচার করে দেয়া হয়। এছাড়াও পণ্যের ভুয়া বিবরণ দিয়ে কিংবা ফ্যান্টম পণ্য (যে পণ্য আসলে আমদানিই করা হয়নি) আমদানির নামে অর্থ চোরাচালান করা হয়ে থাকে। তবে সারা দুনিয়ায় অর্থ পাচার করা হয়ে থাকে সবচাইতে বেশি যে পদ্ধতিতে, সেগুলো হলো ফ্রন্ট বিজনেস-শেল কোম্পানি-অফশোর কোম্পানি, ক্যাসিনো এবং রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট। এই তিনটি প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হলো নিচে। ৪. ফ্রন্ট বিজনেস-শেল কোম্পানি-অফশোর কোম্পানি:: ২০১৬ সালে ফাঁস হওয়া পানামা পেপার কিংবা ২০২১ এ ফাঁস হওয়া প্যান্ডোরা পেপারের কথা মনে আছে? লক্ষ্য লক্ষ্য হাই প্রোফাইল আন্তর্জাতিক ব্যক্তি, যেমন লিওনেল মেসির মতো তারকা থেকে শুরু করে ইলন মাস্কের মতো বিজনেস মুঘল বা ভ্লাদিমির পুতিনের মতো রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের আর্থিক অপরাধ এর কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। পানামা কিংবা প্যান্ডোরা উভয়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল অফশোর ট্যাক্স হেভেন খ্যাত দেশের ব্যবহার, শেল কোম্পানি, অজ্ঞাত মালিকানার উপস্থিতি এবং আর্থিক জালিয়াতি, ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার ইত্যাদি অপরাধের প্রমাণ। এই শেল কোম্পানি, অফশোর বিজনেস আর ফ্রন্ট বিজনেসের মাধ্যমে কিভাবে অর্থ পাচার করা হয় তা নিচে বর্ণনা করা হলো: ধরা যাক কোনো ব্যক্তিবর্গ অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি অর্থ কামালো। এখন সেগুলা ভোগ করার জন্য ক্লিন মানি হিসেবে অর্থনীতিতে ফেরত আনতে হবে। এজন্য তাকে একরকমের দুর্ভেদ্য একটা কর্পোরেট স্ট্রাকচার তৈরি করতে হবে। এজন্য সে প্রথমে হয় একটা কোম্পানি খুলে একটা লেজিটিমেট ব্যবসা দাঁড় করাবে (ফ্রন্ট বিজনেস), যেটার একমাত্র বা অধিকাংশ শেয়ারহোল্ডার সে নিজে, অথবা তার ইতিমধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক কোম্পানিতে অনেক শেয়ার ক্রয় করা আছে। এখন সে একটি অফশোর দেশ ঠিক করবে যেখানে খুব অনায়াসেই একটা হোল্ডিং কোম্পানি (যা আবার অফশোর কোম্পানিও) খুলতে পারে (হোল্ডিং কোম্পানি একধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যাদের মূল কাজ অন্য কোম্পানি ক্রয় করা, অধিকার করা যাদেরকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলে। একটা হোল্ডিং কোম্পানি পণ্য উৎপাদন, কর্মী নিয়োগ, চুক্তিতে আবদ্ধ হয়না)। এই হোল্ডিং কোম্পানিটি তার ফ্রন্ট বিজনেসের সকল শেয়ার অধিকার করবে। হোল্ডিং কোম্পানি তৈরির একটা বড় সুবিধা হলো যদি একটা দাঁড় করানো লাভবান ব্যবসা দেউলিয়া হয়ে যায় তাহলে হোল্ডিং কোম্পানির কাছেই যেহেতু সব শেয়ার থাকে তাই শীঘ্রই আরেকটা ব্যবসা দাঁড় করানো যায় নচেৎ ফ্রন্ট বিজনেস দেউলিয়া হয়ে গেলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেত। এখন ফ্রন্ট বিজনেস থেকে যে লাভ আসে সেটা সেই মালিকের ব্যাংক একাউন্টে যোগ না হয়ে সেই হোল্ডিং কোম্পানির একাউন্টে, যেটা একটি অফশোর ব্যাংক একাউন্ট, যোগ হয়। অতঃপর এই হোল্ডিং কোম্পানির নামে আরও একাধিক ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়, যেগুলোতে অবৈধ টাকা ধীরে ধীরে ডিপোজিট করা হয়। এখন তাহলে বাকি থাকে ওই অফশোর একাউন্টগুলো থেকে টাকাকে বৈধ হিসেবে মালিকের দেশে ফিরিয়ে আনা। এখন হোল্ডিং কোম্পানির যে প্রকৃত মালিক সে অজ্ঞাতনামা থাকতে চায় নিরাপত্তার স্বার্থে। এজন্য সে কাগজে কলমে একটি ট্রাস্ট খুলে বসে। একটি ট্রাস্টে ২ টি এন্টিটি বিদ্যমান: ১. বেনিফিশিয়ারি ২. ট্রাস্টি (ট্রাস্টের ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ যে পাবে তাকে বেনিফিশিয়ারি বলে, যে বণ্টন করবে তাকে ট্রাস্টি বলে)। ট্রাস্টের সুবিধা হলো এটি পরিচয় অজ্ঞাত রাখতে খুবই কার্যকরী। অফশোর দেশের শিথিল আইনের কারণে ট্রাস্টের বেনিফিশিয়ারিকে অজ্ঞাতনামা হয়ে থাকার পথ সুগম করে দেয়। এখন মালিক নিজেই ট্রাস্টের সেটেলার থাকে (নিজেই ট্রাস্ট বোর্ড তৈরি করে), অতঃপর নিজেকে বেনিফিশিয়ারি ঘোষণা করে এবং পরিচিত লোককে ট্রাস্টি বানিয়ে হোল্ডিং কোম্পানি থেকে বৈধ এবং বিপুল অবৈধ টাকা তার অনুমতি সাপেক্ষে ট্রাস্টি তার ব্যাংক একাউন্টে (যেটি মালিকের দেশে অবস্থিত) ট্রান্সফার করে। বাস! বৈধ টাকা রূপে অর্থনীতিতে ফেরত এসে পড়ে অবৈধ টাকা। এই জটিল কর্পোরেট স্ট্রাকচারের কারণে একজন অপরাধী অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। এভাবে শেল কোম্পানি, ফ্রন্ট বিজনেস এবং অফশোর একাউন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়। ৫. রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট: রিয়েল এস্টেট বিজনেস এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিং খুবই প্রচলিত একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তার কারণ একবারেই বড় অংকের টাকা পাচার করা যায়। একটা সম্পদের মূল্য যেহেতু অনেক বেশি হয়ে থাকে তাই বড় অংকের টাকা পাচার নিমিষেই করা সম্ভব হয়। ড্রাগলর্ড, রাজনীতিবিদ, বড় বড় অপরাধ চক্র এভাবে লন্ডারিং করে থাকে। সাধারণত প্রপার্টি ভ্যালু ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে এই ধরনের লন্ডারিং করা হয়ে থাকে। ম্যানিপুলেশন দুই ধরনের, ওভার এবং আন্ডার। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো। ওভার ভ্যালুয়িং: এই ক্ষেত্রে পাচারকারী সর্বপ্রথম যে কাজটি করে তা হলো এক দুর্নীতিগ্রস্ত রিয়েল এস্টেট এজেন্টের শরণাপন্ন হয়। অতঃপর যে প্রপার্টি ক্রয় করতে চায় এজেন্টকে সেটার মূল্য বেশি ধরতে বলে। ধরা যাক, ৫ কোটি টাকার বাড়ি ক্রয় করতে ১০ কোটি টাকার মূল্য নির্ধারণ করতে বললো। এখন ১০ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য মর্টগেজ লোন নিতে ব্যাংকের শরণাপন্ন হবে। এখন ১০ কোটি টাকার ২০% ডাউন পেমেন্ট হিসেবে নির্ধারণ করে বাকি ৮ কোটি টাকার জন্য মর্টগেজ লোন নেয়া হলো (প্রকৃত মূল্য ৫ কোটি টাকা হলেও ৮ কোটি টাকা মর্টগেজ লোন নেয়ার কারণ একবারেই বেশি পরিমাণে কালোটাকা সাদা করতে পারবে)। অতঃপর নির্ধারিত ডাউন পেমেন্ট বৈধ টাকা দিয়ে পরিশোধ করে লোনের টাকা দিয়ে বাড়িটি ক্রয় করলো, অর্থাৎ মোট ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলো। এখন এই ৮ কোটি টাকার লোন কিস্তিতে অবৈধ টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে পরিশোধ করে অবৈধ টাকা ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমে প্রবেশ করাবে। এভাবে সে বাড়িটা অধিকার করলো। এখন তাহলে অবৈধ টাকা বৈধ করা হলো, কিন্তু টাকাগুলো তো আর তার কাছে নেই, অর্থাৎ এখন সেগুলোকে ফেরত আনতে হবে। সেজন্য, যখন সেই লোন পরিশোধ শেষ হয়ে যাবে, তার বেশ কিছু সময় পর বাড়িটা সেই বর্ধিত দামে (১০ কোটি, যেটা কাগজে কলমে প্রকৃত দাম) বিক্রি করবে অন্য কারো কাছে এবং এভাবে সে তার টাকা উঠিয়ে নিবে। এভাবে সে অবৈধ ৮ কোটি টাকা বৈধ করিয়ে নিলো। আন্ডার ভ্যালুয়িং: এবার এজেন্টকে বলা হয় বাড়ির মূল্য ১০ কোটি (ধরি এটি প্রকৃত মূল্য) কে ৫ কোটি হিসেবে উপস্থাপন করতে। অতঃপর পাচারকারী ব্যাংকে যেয়ে ৫ কোটির ২০% ডাউন পেমেন্টে ৪ কোটি টাকার জন্য মর্টগেজ লোন নিলো। ডাউন পেমেন্টটি নিজের বৈধ উপার্জন দিয়ে পরিশোধ করে লোনের টাকা দিয়ে বাড়িটি ক্রয় করলো। লোনের বাকি অংশ কিস্তিতে অবৈধ টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে পরিশোধ করে অবৈধ টাকাকে ইন্টিগ্রেট করে ফেললো্ অর্থনীতিতে। এভাবে বাড়িটি অধিকার করলো। অতঃপর টাকা ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্যে ১০ কোটিতে বাড়িটি পুনবিক্রয় করবে, যেটি এক্ষেত্রে বাড়িটির প্রকৃত বাজারমূল্য এবং এভাবে অবৈধ ৪ কোটি টাকা বৈধ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত ৫ কোটি টাকাও লাভ আকারে নিজের মালিকানায় নিয়ে নিলো।এভাবে ভ্যালুয়িং ম্যানিপুলেশন এর মাধ্যমে পাচারকারী সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ায় নিজের কালোটাকা সাদা করতে সক্ষম হয়ে থাকে। ৬. ক্যাসিনো: ক্যাসিনোর মাধ্যমে মানি লন্ডারিং বর্তমানে খুবই পরিচিত একটি ঘটনা। এক্ষেত্রে যে জিনিসটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে সেটি হলো ক্যাসিনো চিপ (এটি ক্যারামবোর্ড এর গুটির মত দেখতে অনেকটা)। কিভাবে ক্যাসিনোতে মানি লন্ডারিং করা হয় একটু ছোট উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক। ধরা যাক, পাচারকারী ১ কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করলো। এখন সে ক্যাসিনোতে ওই টাকা নিয়ে এসে তার সমমূল্যের চিপ কিনল ক্যাশিয়ার থাকে। ক্যাসিনোতে অনেক বড় বড় অংকের বিপরীতে জুয়া খেলা হয় বিধায় ১-২ কোটি টাকার জন্য ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ খেলোয়াড় এর আয়ের উৎস তলব করে না (জ্বি, এখানে ১-২ কোটি টাকা খুবই ছোট একটি পরিমাণ)। অতঃপর সে যেকোনো খেলায় নামমাত্র অংশগ্রহণ করলো, কারণ তার লক্ষ্য টাকাকে খেলায় জিতার উপার্জন হিসেবে দেখানো। ব্ল্যাকজ্যাক বা পোকার কোন একটি খেলা কয়েক রাউন্ড খেলার পর, সে হারতেও পারে আবার জিততেও পারে, ধরা যাক ১০ লাখ টাকা হারালো, অতঃপর বাকি ৯০ লাখ টাকার চিপ ক্যাশিয়ারের কাছে নিয়ে টাকায় কনভার্ট করে খেলায় জিতার পুরস্কার রূপে বৈধ টাকা হিসেবে নিয়ে চলে গেলো। এখন পাচার করতে চাওয়া টাকার পরিমাণ যদি অনেক বেশি হয়, ধরা যাক ৫০-১০০ কোটি টাকা। তখন উপরে পূর্বে উল্লেখিত স্মার্ফিং এর মত, পাচারকারীর পরিচিত কতিপয় জুয়াড়ি দ্বারা মোট টাকা ছোট অংশে ভেঙে তাদের দিয়ে একাধিক ক্যাসিনোতে একই প্রক্রিয়ায় সাদা করিয়ে আনে। এভাবে বৈধ টাকা রূপে ব্যাংক একাউন্টে জমা হতে থাকে। এভাবে ক্যাসিনোতে কালোটাকা সাদা করা হয়। মানি লন্ডারিং এর প্রভাব: এই আর্থিক অপরাধের প্রভাব একটি অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী। দেশের যে সেক্টরে অবৈধ অর্থের অন্তপ্রবাহ হয় সেই সেক্টরে দ্রব্য, সেবার দাম ব্যাপক বৃদ্ধি পায়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি হয়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে , কারণ গুটিকয়েক কোম্পানি (যারা অবৈধ টাকা ব্যবহার করে) তাদের হাতে রিসোর্স, সুবিধা, মার্কেট পাওয়ার বেশি থাকে। যে দেশ থেকে টাকা পাচার হয় সেই দেশ মূলধন সংকটে পড়ে। যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচারের কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়ে তাদের সুনাম নষ্ট হয় ব্যাপকভাবে, ফলে ভোক্তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং আস্থা উঠিয়ে ফেলে। ২০১২ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি এইচএসবিসি এর অর্থ পাচার কেলেংকারীর পরে গ্রাহকদের সংখ্যার ব্যাপক হ্রাস পরিলক্ষিত হয়। আনুমানিক ১.৫ মিলিয়ন গ্রাহককে ১৮৫ মিলিয়ন ইউরো ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। অর্থ পাচারের কারণে অনেক সুসংগঠিতভাবে অপরাধ পরিচালনা করা যায়। টেরোর ফান্ডিং খুবই অনায়াসে করা সম্ভব হয়ে যায়। সমাজে আয় বৈষম্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। গুটিকয়েক ব্যক্তিবর্গের কিংবা কোম্পানির হাতে অঢেল অর্থ ও ক্ষমতার আবির্ভাব হয়। অর্থ পাচার দুর্বল অবকাঠামো ও আইনহীনতার ফল। তাই বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমতে শুরু করে। এই অপরাধ বৃদ্ধি পেলে এই অপরাধ মোকাবেলার জন্য অর্থ ও শ্রম বিপুলভাবে ব্যয় হয়। সর্বোপরি ক্রমবর্ধমান অর্থ পাচারের কারণে একটি দেশের জনগণ, অর্থনীতি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, সমাজ প্রতিটি উপাদানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু অর্থ পাচারের মতো অপরাধ দ্বারাই একটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি। অর্থ পাচারের বিতর্কিত ভালো দিক: অনেক রাজনীতিবিদ যুক্তির খাতিরে বলে থাকেন যে অর্থ পাচারের কিছু ভালো দিকও আছে, যদিও সেগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রমে, তবুও সেগুলো কতটুক সত্য আমি নিশ্চিত না। কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। যে সকল খাতে অর্থ পাচার হয় সেখানে তারল্য বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বৃদ্ধি ঘটে থাকে। যেমন কর্মসংস্থান তৈরি। এটা বলা হয় যে অর্থ পাচারের জন্য যে সকল ফ্রন্ট বিজনেস যেমন রেস্টুরেন্ট, কার ওয়াশ, অ্যাপারেল স্টোর ইত্যাদি স্থাপন করা হয়, সেগুলাতে কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হয়। সাধারণ আমজনতা থেকে কর্মী নিয়োগ করা হয় যাদের কোনো ধারণা নেই সেই দোকান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কি, তারা স্বাভাবিকভাবেই কাজ করতে যায়, এমন মানুষগুলার রুটি রুজি তৈরি হয়। কিন্তু আমি মনে করি এগুলো স্থিতিশীল না, কারণ যদি মালিকপক্ষ ধরা পড়ে তাহলে তদন্তে উঠে আসা ফ্রন্ট বিজনেস অবৈধ ঘোষণা করে, ফলশ্রুতিতে কর্মীরা কর্মসংস্থান হারায়ে আবার বেকার হয়ে পড়ে। এরপর আসা যাক রিয়েল এস্টেটে। আমি মনে করি এই অপরাধ থেকে প্রাপ্ত অঢেল অর্থের কারণে এই খাতের উপাদানের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা কোম্পানির হাতে পুঁজি পুঞ্জীভূত হয়, নতুন কোম্পানি প্রতিযোগিতা করার সুযোগ হারায়, অর্থনৈতিক বাবল (স্টক, রিয়েল এস্টেট, পণ্য ইত্যাদি এসেটের অতি অল্প সময়ে আকাশছোঁয়া মূল্য) তৈরি করে যা পরবর্তীতে বার্স্ট হওয়ায় অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় ব্যবসার মালিকেরা। এরপর ব্যাংকে মূলধনের বৃদ্ধি। এমন আলাপ আছে যে, এতে ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাস্তবে এটাও অমূলক কারণ অপরাধী ওই টাকা বারবার বিভিন্ন একাউন্টে ট্রান্সফার করতে থাকে এবং শেষমেশ দেশের বাহিরে নিয়ে যায়। অর্থাৎ যেসকল যুক্তি দেখানো হয় সেগুলো সবই অবাস্তব, অস্থিতিশীল। আর যদি কোনোটি হয়েও থাকে তবে সেটা খুবই স্বল্প সময়ের জন্য প্রযোজ্য হলেও লম্বা সময়ের জন্য কখনোই প্রযোজ্য হয় না। আর স্বল্প সময়ের জন্যেও যেটুকু হয় তার মূল কারণ দুর্নীতিপরায়ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সহায়তা। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলের পুকুরচুরি: ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি এক বিতর্কিত ভোটের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়। এরপর ২০১৪, ২০১৯, ২০২৪ এ ভোটডাকাতি ও চরম দুর্নীতিপরায়ন শাসনের মাধ্যমে একটি অযোগ্য শাসক হিসেবে দেশের নির্বাহী প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকে, অতঃপর ৫ আগষ্ট, ২০২৪ সনে সফল ছাত্র – অভ্যুত্থান এর মাধ্যমে সেনা সহায়তায় প্রাণ নিয়ে দেশ পলায়নের মাধ্যমে এই অরাজকতার যুগের অবসান ঘটে। তার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে যে পরিমাণ দুর্নীতি, বিশেষ করে আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়, বিশ্লেষকদের দাবি, হাসিনার রাজত্ব টিকে থাকলে ২০২৫-২০২৬ এ দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিত এবং দেশ রিজার্ভশূন্য হয়ে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গুঁড়িয়ে যেত। তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতারা বা তাদের মদদে বড় বড় ব্যবসায়িক নেতারা এই ১৫ বছরে কিছু অবিশ্বাস্য অর্থ পাচার এর ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, যার মূল্য পুরো দেশবাসীকে আজও দিতে হচ্ছে। নিম্নে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: (২০১৪) আব্দুল হাই বাচ্চু, আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিয়োগকৃত জাতীয় পার্টির নেতা ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদের আসন ৫ বছরের জন্য লাভ করে। তার সময়ে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থাৎ সেসময়ে যা ৪৫ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের ছিল। বাচ্চুর আদেশে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইচ্ছেমত ঋণ প্রদান করত কোনো বন্ধক ছাড়াই। আর পাচারকারীরা শেল কোম্পানির মাধ্যমে ভুয়া একাউন্টে বিদেশে অর্থ চালান দিত। এস আলম গ্রুপ কেলেঙ্কারি: বর্তমানে সবচাইতে সমালোচিত শিল্প প্রতিষ্ঠান হলো এস আলম, যা মূলত একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কংগলোমিরেট, ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। এদের শুধু কুকীর্তি নিয়েই আলাদা একটি ব্লগ লেখা সম্ভব তবে এখানে সংক্ষেপে মানি লন্ডারিং এর বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করব। আওয়ামী সরকারের আমলে এই এস আলম গ্রুপ দ্বারা অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার, জোরপূর্বক ব্যাংক দখল, অর্থ লুটপাটসহ যত আর্থিক অপরাধ আছে সব কিছু করার প্রমাণ মেলে। এস আলম গ্রুপ আর আওয়ামী সরকারের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল সেটি ছিল স্পষ্টত ক্লায়েন্টেলিজম অর্থাৎ সরকার কর্তৃক সকল রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করত, সহায়তা পেত বিনিময়ে সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সকল ধরনের সহায়তা করত, হোক সেটি ফান্ডিং দিয়ে কিংবা অনুগত প্রশাসনিক কর্মকর্তা দিয়ে কিংবা টার্গেটেড দাঙ্গা স্পন্সর করে। এস আলম গ্রুপ কর্তৃক দেশের ব্যবসায়িক ব্যাংক গুলোর মেরুদণ্ড ভেঙে যায় যার সরাসরি প্রভাব দেশের মধ্যবিত্ত থেকে নিচের সারির মানুষেরা প্রতিনিয়ত ভোগ করে। গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম , তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, গ্রুপের শেয়ারহোল্ডার এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও আর্থিক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। সিআইডির তথ্যমতে, সাইফুল এবং তার স্ত্রী ১,১৩,২৪৫ কোটি টাকা জালিয়াতি, ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং হুন্ডির মাধ্যমে এর মাধ্যমে পাচার করে। আরো প্রকাশ করা হয় তাদের পরিবার ২৪৫.৭৫ কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করে এবং এছাড়াও পূর্ব ইউরোপে এবং মালেশিয়াতে ভুয়া কোম্পানির নামে পাচার করা হয়। এছাড়া আরো ১৮০০০ কোটি টাকা শেল কোম্পানির মাধ্যমে পাচার করা হয়। গভর্নর আহসান মানসুর এর মতে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি করে এস আলম গ্রুপ, এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসারে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা (১৬.৬ বিলিয়ন ডলার) পাচার করে। ডেসটিনি গ্রুপ কেলেঙ্কারি: (২০১২) ডেসটিনি গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রফিকুল আমীন সিনিয়র কর্মকর্তাসহ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পিরামিড স্ক্যাম চালিয়ে সেই টাকা শেল কোম্পানি আর ভুয়া প্রজেক্টের নামে বিদেশে পাচার করে। ক্যাসিনো স্ক্যান্ডাল: (২০১৯) আওয়ামী লীগের যুবসংগঠন, যুবলীগের শীর্ষ নেতা, বড় বড় ব্যবসায়ী, আইন প্রণেতারা ঢাকায় অবৈধ ক্যাসিনোতে জুয়ার আসরে অর্থ পাচার করত। সাবেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার মতো শীর্ষ সারির নেতারা জড়িত ছিল এ কেলেংকারিতে। পাচারকৃত টাকার সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে আজও জানা যায়নি তবে লোকাল রিপোর্ট অনুযায়ী ধারণা করা হয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করা হয় রিয়েল এস্টেট, অফশোর, হাওয়ালা সিস্টেমের মাধ্যমে। হলমার্ক গ্রুপ কেলেঙ্কারি: (২০১২) হলমার্ক গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোন নিয়ে আত্মসাৎ করে বিদেশে ভুয়া কোম্পানির নামে পাচার করে আর কিছু অর্থ দেশে পুনরায় বিনিয়োগ করে ব্যবসা বাণিজ্যে। প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে তাদের সখ্যতার কারণে কোনো পর্যাপ্ত বাছবিচার এর মুখোমুখি না হয়েই ব্যাংক থেকে লোন নিতে সক্ষম হয়। ক্রিসেন্ট গ্রুপের কেলেঙ্কারি: (২০১৯) বিজনেস কংগলোমিরেট হিসেবে খ্যাত ক্রিসেন্ট গ্রুপ প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার বা ৩০ হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার করে ভুয়া রপ্তানি ইনভয়েস (ফ্যান্টম গুডস) দেখিয়ে। গ্রুপের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতারা এই অপরাধের অংশীদার ছিল। আননটেক্স গ্রুপ কেলেঙ্কারি: (২০১৮) আননটেক্স গ্রুপ দেশের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল কংগ্লোমিরেট। সিস্টার কোম্পানি ও শেল কোম্পানির নামে জনতা ব্যাংক থেকে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার বা ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করে অফশোর একাউন্টে। জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এই অপরাধে জড়িত ছিল, তারা কোনো বন্ধক ছাড়াই ভুয়া লোন দিত গ্রুপকে। এভাবে এত বড় অপরাধ অনায়াসে ঘটতে সক্ষম হয়। এরকম শত শত অর্থ পাচারের ঘটনার প্রমাণ মেলে গত দের যুগে। যার ফলে আজ আমাদের দেশের অর্থনীতি পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। মানি লন্ডারিং বন্ধে আওয়ামী সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ: অর্থ পাচার প্রতিরোধ করতে আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল, যদিও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তবে পদক্ষেপগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। দেশের অভ্যন্তরে ও বাহিরে উদীয়মান টেরোরিজম জন্য ২০০৯ সালে প্রণীত এন্টি টেরোরিজম অ্যাক্ট এর মাধ্যমে টেরোরিজম এর জন্য কোনো প্রকার অর্থায়নকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর দন্ডবিধি হিসেবে দণ্ডিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সম্পত্তি ফ্রিজ করা, বাজেয়াপ্তিকরণ, জেল, আর্থ দণ্ড ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ে আইন পাশ হয়। এরপর ২০১২ সালে খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটি পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ২০০৯ এর মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্টকে সংশোধন করে ২০১২ সালে প্রণীত হয় দ্যা মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট ২০১২ থাকে সংক্ষেপে এমএলপিএ ২০১২ বলা হয়। এটি সংশোধিত হয় ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধ সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) এর মূলনীতি অনুসারে। এই অ্যাক্টে মানি লন্ডারিং এর সংজ্ঞা, শাস্তিবিধি নতুন করে নির্ণয় করা হয়। এমএলপিএ এর আইনানুসারে নো ইউর কাস্টমার (কেওয়াইসি) এবং কাস্টমার ডিউ ডিলিজেন্স (সিডিডি) নামক দুইটি গুরুত্বপুর্ণ ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, যেকোনো কাস্টমার, বিশেষ করে পলিটিকালি এক্সপোজড পার্সন (পেপ) বা অতীতে অপরাধের রেকর্ড আছে এমন কোনো ব্যক্তির ব্যাকগ্রাউন্ড খুব কড়াভাবে চেক করে, সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ণয় করাসহ অনেক কঠিন প্রসেসের মধ্য দিয়ে এসে একাউন্ট খোলা, অর্থ স্থানান্তর এর জন্য অনুমতি দেয়া হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক এর আন্ডারে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি এমএলপিএ ২০১২ এর প্রণীত আদেশমালা বাস্তবায়নের সহায়তা করে। এটি সন্দেহজনক সকল ট্রানজেকশন রিপোর্ট গ্রহণ ও বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিং প্রতিহত করে। এছাড়াও এটি ট্রেনিং ও অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও দুর্নীতি দমনে কমিশন ও সিআইডির মতো ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিতে মানি লন্ডারিং এর জন্য স্পেশাল ইউনিট চালু করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে বাংলাদেশ সমন্বয় করে। যেমন এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি)। এছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে এফএটিএফ এর ৪০ টি উপদেশ মেনে চলেছে। এছাড়া রিয়েলি স্টেট এবং গোল্ড মার্কেট এর মতো সংবেদনশীল খাতে আইনের তৎপরতা জোরদার করা হয়।এছাড়া ক্রস বর্ডার ট্রানজেকশন এর ক্ষেত্রেও মনিটরিং জোরদার করা হয়। ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডাররা (এমএফএসপি) যেন এমএলপিএ ২০১২ এর নিয়ম মেনে চলে তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গাইডলাইন প্রণীত হয়। এছাড়াও সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক, পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনমালা ও রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক প্রণীত হয়। কেনো আওয়ামী সরকার মানি লন্ডারিং প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলো: গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই), একটি ওয়াশিংটন ডিসি বেজড থিঙ্ক ট্যাংক এর প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয় যার মূল মাধ্যম হলো জাল ইনভয়েসিং, হুন্ডি, অফশোর কোম্পানি। জিএফআই এর রিপোর্ট অনুসারে ২০০৫-২০১৪ সময়ে ৬১.১ বিলিয়ন ডলার পাচার হয় বিদেশে এবং দেশটি প্রতিবছর বার্ষিক হিসেবে ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার হারায় জাল ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে, যেটা ২০৩০ এর মধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিল। ২০২৩ সালের দ্যা ডেইলি স্টারের একটি রিপোর্টে বলা হয়,বাংলাদেশ কাস্টম ৩৩ টি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও বায়িং হাউজের সন্ধান পেয়েছে যারা গত ছয় বছরে ৮২১ কোটি টাকা পাচার করেছে। সরকার কর্তৃক এত পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও তাহলে কিভাবে এত অর্থ পাচার হয়? এটার প্রধান কারণ ক্যাবিনেটে থাকা নির্বাহী অফিসারদের অসারতা। একটি দেশের সুপ্রিম ডিসিশন–মেকিং কমিটি যখন দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তখন সব রকমের অপরাধের দুয়ারই খুলে যায়। মানি লন্ডারিং নিয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের তার সময়কালে করা একটি বক্তব্য রয়েছে যেখানে বলা হয়, “অর্থ পাচার হয়নি এটা বলবো না তবে যা হয়েছে বাস্তবে সেটাকে অনেক বাড়িয়ে বলা হয় মিডিয়াতে।“ বিগত অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, “তার কাছে অর্থ পাচার সম্পর্কিত তথ্য বের করার কোন উপায় জানা নেই।“ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের থেকে এমন মন্তব্য সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। এছাড়াও কারণ হিসেবে রয়েছে আইনের যথাযথ ব্যবহারে ব্যর্থ হওয়া। যেমন এমএলপিএ ২০১২ একটি যুগোপযোগী সংস্কার হলেও, মোটেই তার প্রয়োগ বাস্তবে যথাযথভাবে হয়নি। এছাড়াও দক্ষ, যোগ্য ও সৎ অফিসিয়ালদের অভাবটিও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। দেখা গেছে যে, এসকল ক্ষেত্রে কাজের পরিবেশটি এমন ছিল একজন অফিসার তার কাজ সঠিকভাবে পরিচালিত করতে নিরুৎসাহ পেতেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপর মহল থেকে চাপ থাকতো এসকল বিষয় উপেক্ষা করে যাওয়ার। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অন্যতম প্রধান কারণ। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ বডির সদস্যদের দুর্বল মনিটরিং। তারা অনেক সন্দেহজনক ট্রানজেকশন সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মত এজেন্সির কর্মক্ষেত্রে পরাধীনতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে কাজে বাধা প্রদানের মতো বিষয়াদিও খুবই গুরুত্বপুর্ণ। হুন্ডি ব্যবস্থার কারণেও অনেক অর্থ পাচার হয়ে থাকে, দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার অত্যধিক জটিলতা, অস্বচ্ছতার কারণে বিদেশে টাকা আদান প্রদানের ক্ষেত্রে হুন্ডি যথারীতি একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া দুর্বল বিচার কাঠামো, ধীর গতির প্রসিকিউশন, অতিরিক্ত বিউরোক্রেটিক জটিলতা, প্রায়শই রাজনৈতিক চাপসহ নানাবিধ কারণে আওয়ামী সরকারের আমলে মানি লন্ডারিংসহ কোনরকমের আর্থিক অপরাধ প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি, তবে আইন ও নিয়ম প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনোকিছু বাদ রাখেনি শেখ হাসিনার সরকার। এরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল হিসেবে দেশের মধ্যবিত্ত- নিম্নবিত্ত পরিবারের মানবেতর জীবন যাপন, ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙন, রিজার্ভ দ্রুত হারে কমা, ব্যাংকিং ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে যাওয়াসহ ইত্যাদি কারণে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ধ্বসে পড়ে, সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পায়, অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধি পায়, তরুণদের মাঝে হতাশাগ্রস্ততা তৈরি হয়, চাকরিবাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, এভাবে দেশ এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বর্তমান উপদেষ্টা সরকার অর্থ পাচার প্রতিরোধে যা করতে পারে: ৫ আগষ্টের ৩ দিন পর শান্তিতে নোবেলবিজয়ী মাইক্রোক্রেডিটের জনক ড. মুহম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার আসন গ্রহণ করে তাঁর ক্যাবিনেট সরকার গঠন করেন। তাঁর সামনে বর্তমানে বিদ্যমান পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। আগের দু:শাসক এর দেড় যুগের জঞ্জাল পরিষ্কার করে একটি সুস্থ এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ উপহার দেয়ার লক্ষ্যেই নিয়োজিত আছেন তিনি। তার এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে ও দেশের অগ্রগতির স্বার্থে আর্থিক খাতকে মজবুত করার বিকল্প নেই, সেই সাথে সকল ধরনের আর্থিক অপরাধ প্রতিহত করা বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন রিপোর্ট মতে, গত দেড় যুগ ধরে ১১ লক্ষ্য কোটি টাকার বেশি দেশ থেকে পাচার হয়, যার মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা উধাও হওয়া বিদ্যমান, যার মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা আবার ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে বর্তমান গভর্নরের বক্তব্যমতে। ফলে বাজারে তারল্য সংকট কিছুটা কমেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বর্তমান সরকারকে সর্বপ্রথম ব্যাংকিং খাতকে মজবুত করা উচিত বলে আমি মনে করি। আর ব্যাংকিং খাতকে মজবুত করার জন্য সর্বপ্রথম কাজ হলো নির্বাহী পর্যায়ের বিরাজনীতিকরন। দেশের প্রায় ৪০টির মত ব্যাংক মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোর বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের সাথে বসে ব্যাংকগুলোকে পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। সৎ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দেয়া, রাজনৈতিকভাবে অসৎ এমন লোককে বরখাস্ত করার মতো শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকগুলোর জন্য কম্পিটিটিভ ক্লায়েন্টেলিজোম নিশ্চিত করতে হবে, অর্থাৎ কিছু নির্দিষ্ট ব্যাংক যেন তার বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনুসারী হওয়ার সুবাদে বেশি সুযোগ সুবিধা না পায় সেটি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কর্মতৎপরতা বাড়াতে হবে; কেওয়াইসি , সিডিডি এর মত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফ্রেমওয়ার্কগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এমএলপিএ ২০১২ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় গৃহীত না হয়, সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে। মানি লন্ডারিং এর সবচাইতে ভালনারেবল ধাপ হল প্লেসমেন্ট, এই ধাপেই মানি লন্ডারিং শনাক্তকরন সবচেয়ে সহজ। তাই এই ধাপের সাথে সংশ্লিষ্ট বডিদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিগুলোকে (যেমন বিএফআইইউ , দুদক) তাদের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা ফেরত দিতে হবে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে, তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বরখাস্ত নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক অপরাধের শাস্তিকে আরো কঠোর করতে হবে। দেশের মানুষের টাকা চুরি দেশের সাথে বেইমানি, এই মতে বিশ্বাসী হয়ে বড় বড় অর্থ পাচারে দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান চালু করাও অযৌক্তিক নয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর অডিট রিপোর্ট জমা দেয়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে সুযোগ্য অডিটকারীকে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি ব্যাংকের জন্য সাসপিশস ট্রানজেকশন রিপোর্ট (এসটিআর) প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রেসকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কোনো সাংবাদিককে তার অনুসন্ধানমূলক কাজের জন্য জেরা করার কালচারের ইতি টানতে হবে।সরকারি বা বেসরকারিভাবে এরকম সেনসিটিভ সেক্টরের অপরাধ শনাক্তকরণের জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক আনতে হবে। ব্যাংকিং প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে তাহলে হুন্ডী ও হাওয়ালা সিস্টেমের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমবে কারণ মনে রাখতে হবে মানুষ স্বভাবতই অপরাধপ্রবণ নয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে মিলবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে, তাদের উপদেশগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে এবং যথাযতভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাদের থেকে সহায়তা পাওয়ার পথকে প্রশস্ত করতে হবে। কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে শক্ত হতে হবে। আমার বিশ্বাস এসকল বিষয়গুলিকে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা গেলে আর্থিক অপরাধের মাত্রা উল্ল্যেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। এভাবে মানি লন্ডারিংয়ের মতো জঘন্য একটি অপরাধকে প্রতিহত করা সম্ভব। অর্থ পাচার একটি রাষ্ট্রের শুধু আর্থিক সক্ষমতাকেই দুর্বল করে না কিংবা দেশের নিরাপত্তাকেই শুধু বিঘ্নিত করে না বরং এটা সেই দেশের সমাজকে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। যদিও আমাদের বর্তমান উপদেষ্টা সরকার প্রাথমিকভাবে সাফল্যের আলো দেখেছেন তবুও সংগ্রাম মোটেও শেষ হয়নি, জাতি হিসেবে আমাদের সবার সহযোগিতা ও একতা, আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা, প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমাগত দরকার এই অপরাধ প্রতিরোধে। আমরা সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সুশিক্ষা ও নৈতিকতার সংমিশ্রণবলে এই ঘৃণ্য অপরাধ রোধে ভূমিকা রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
0 Comments
Leave a Reply. |
Send your articles to: |